ডেস্ক রিপোর্ট :
প্রচণ্ড গরমে নাজেহাল দেশবাসী। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪২ ডিগ্রিতে। তীব্র এই দাবদাহে পানি পান না করে দীর্ঘক্ষণ বাইরে কাজ করলে যে কারও হতে পারে হিট স্ট্রোক। চিকিৎসকরা বলছেন, হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ৩০ থেকে ৫০ শতাংশেরই মৃত্যু হয়ে থাকে। তাই এ অবস্থায় সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই।
চিকিৎসকদের মতে, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে দেহের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে। প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়। সাধারণত ছোট বাচ্চা, বয়স্ক লোক, ব্যায়ামবিদ বা দিনমজুরদের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভয়াবহ, তাদের দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম ডেভেলপড না হওয়ায় তাদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, গত কিছুদিন যাবত দেশে গরমটা অনেক বেশি। বাইরে কাজ করতে গেলে পানের সঙ্গে শরীরের লবণটাও বের হয়ে যায়। এতে করে শরীরে দুর্বলতা, অবসাদ, ক্লান্তি, মাথা ঘোরানো, প্রেসার কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও গরমে মানুষ রাস্তাঘাটে দূষিত পানি, শরবতসহ আজেবাজে নানা কিছুই খেয়ে থাকে, এর ফলে অসংখ্য ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী আমরা গত কিছুদিন দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ হলো যারা দীর্ঘক্ষণ রোদে কাজ করে, তাদের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ১০৫ ডিগ্রি পার হয়ে গেলে দেখবেন মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি, এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে, যাকে বলা হয় হিট স্ট্রোক। এটি খুবই ভয়াবহ। এমনটা হলে দ্রুত শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে অনেকক্ষেত্রে মারাও যেতে পারে।
প্রখ্যাত এই চিকিৎসক বলেন, যারা ক্রনিক রোগে ভুগছেন; বিশেষ করে কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের রোগী তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। অতি জরুরি কোনও কারণ ছাড়া তারা যেন এই প্রচণ্ড রোদের তাপমাত্রায় বাইরে বের না হয়।
সচেতনতা প্রসঙ্গে এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এই তাপমাত্রায় কারও বাইরে যাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে যারা ছোট বাচ্চা ও গর্ভবতী নারী- তাদের ঝুঁকিটা বেশি। আর রিকশাওয়ালা, দিনমজুরসহ যাদের বাধ্য হয়েই কাজের তাড়নায় বাইরে যেতে হয়, তারা যেন সঙ্গে করে ছাতা নিয়ে বের হয়। এমনকি ঘণ্টাখানেক পরপর কিছুক্ষণের জন্য হলেও ছায়াতে বসে পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার কাজে যায়।
তিনি বলেন, যারা রোজা রাখেন তারা ইফতারের পর বেশি বেশি করে পানি খাবেন। সম্ভব হলে পানিতে একটু লবণ মিশিয়ে নেবেন। লবণ মিশ্রিত পানিটা শরীরের ঘাটতি কিছুটা পূরণ করবে। এক্ষেত্রে ইফতারের পর ওরস্যালাইনও খাওয়া যেতে পারে।
এবিএম আবদুল্লাহ আরও বলেন, গরম থেকে বাঁচতে কাপড়চোপড় পরা উচিত ঢিলেঢালা। বেশি টাইট জামা পরলে শরীর থেকে তাপ বের হতে পারে না। যথাসম্ভব পাতলা জাতীয় কাপড় পরিধান করবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তৌফিক আহমেদ বলেন, এই গরমে দীর্ঘ সময় রোদে থাকলে হিটস্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে যে কেউ, বাড়তে পারে শরীরের অন্যান্য জটিলতা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই ঝুঁকি আরও বেশি। তাই এই সময়ে নিজের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজন হয় একটু বাড়তি যত্ন, একটু বাড়তি সতর্কতা।
তিনি বলেন, হিট রিলেটেড অসুস্থতাকে আমরা সাধারণত ৫ ভাগে ভাগ করি। সেগুলো হলো- হিট ইডিমা, হিট ক্র্যাম্প, হিট সিনকোপ, হিট একজেশন এবং হিট স্ট্রোক। এক্ষেত্রে কারও হিট ইডিমা হলে হাত-পা ফুলে যাবে। সাধারণত গরমের জন্য ভেসোডাইলেশনের জন্য এটি হয়। আর হিট ক্র্যাম্প হয় ইলেকট্রোলাইট ফ্রি তরল জাতীয় খাবার অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে। এই সমস্যায় বিশেষ করে মাংসপেশির ব্যথা হয়। এছাড়াও হিট একজেশন হয় যখন তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ হয়। তখন শরীর তার মেটাবলিজম কমিয়ে দেয় এবং শরীরকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। তবে, শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যায়।
‘এছাড়াও হিট সিনকোপ হলো এর পরের ধাপ। বিশেষ করে যাদের হ্নদরোগ বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, তাদের দেহের তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে হিট সিনকোপ হয় এবং রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। এবং সর্বশেষ হলো হিট স্টোক।’
ডা. তৌফিক বলেন, হিট স্ট্রোক খুবই খারাপ জিনিস। বলা হয়ে থাকে কেউ যদি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, তার মর্টালিটি রেট (মৃত্যু হার) ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। যেহেতু গত কিছুদিন যাবত দেশে গরমটা বেশ পড়েছে, আমরাও বেশকিছু হিটের রোগী পাচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত ক্রিটিক্যাল রোগী খুব কমই পেয়েছি।
বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের এই চিকিৎসক বলেন, অতিরিক্ত গরম পড়লে আমরা মানুষকে বাইরে বের না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেই। এছাড়াও সময়ের মধ্যে এক্সারসাইজ বা কায়িক পরিশ্রম থেকে যতো বিরত থাকা যায়, ততোই ভালো। বিশেষ করে যে সময়টায় তাপমাত্রা বেশি থাকে।
করণীয় প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রোগীর বমি হতে পারে, অবচেতন হতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে এবং শরীর মেজর অর্গানগুলো ইফেক্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। একটি হলো হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে আমরা কী করব, দ্বিতীয়টি হলো হিট স্ট্রোক হয়ে গেলে আমাদের করণীয় কী হবে। হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করার জন্য যে সময়টাতে গরম বেশি থাকে, তখনকার কাজগুলো রুটিন করে অন্য সময় করে নেব। যেমন আমরা দেখি যে সকাল-সকাল রোদ কিছুটা কম থাকে, দিনে বাইরে কোনও কাজ থাকলে সেই সময়টাতে কাজগুলো আমরা করে ফেলব। আমরা যে পোশাকগুলো পরবো, সেগুলো যেন একটু ঢিলে-ঢালা হয় এ বিষয়টি মাথায় রাখব। চেষ্টা করব তরল জাতীয় খাবারগুলো বেশি খাওয়ার। সবচেয়ে ভালো হয়, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, তরমুজ, পর্যাপ্ত পানি খেতে পারলে। তবে মনে রাখতে হবে অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।
ডা. তৌফিক বলেন, গরমে কেউ যদি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাকে গরম জায়গা থেকে ঠান্ডা কোনও জায়গায় নিয়ে আসতে হবে এবং বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। হসপিটালে ভর্তির পর আমাদের অনেকগুলো ট্রিটমেন্ট আছে। যদি দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে আমরা সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি। তবে হিট স্ট্রোকে মৃতের হারটাও আশঙ্কাজনক।
তিনি আরও বলেন, যদিও এবছর এই ধরনের রোগীগুলো আমরা এতটা পাইনি, তবে গত বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী আমরা পেয়েছি। তাপমাত্রা বেশি থাকা সত্ত্বেও রোগী কম আসার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তো রমজান মাস চলছে। এ মাসে যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে, মানুষ তাদের অতিরিক্ত কাজগুলো আগেভাগেই করে ফেলে এবং খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না। এর পেছনে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে আমাদের মিডিয়াগুলো। বরং শুরু হতেই তারা নানা সচেতনতামূলক সংবাদ ও ইন্টারভিউ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যে কারণে তীব্র রোদের এতোটা ভয়াবহতা আমরা দেখিনি।
চলমান তাপদাহে হিট স্ট্রোক থেকে নিরাপদ থাকতে মানতে হবে কিছু নিয়ম-
গরমে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি যে কোনও ঝুঁকি এড়াতে বেশ কিছু পরামর্শ (ফেসবুক পোস্ট) দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নাজিরুম মুবিন। সেগুলো হলো-
১. হাইড্রেটেড থাকুন- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। রোজাদাররা ইফতার ও সেহরির মাঝখানের সময়টাতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। চা, কফি এড়িয়ে চলুন। চা, কফির ক্যাফেইন আপনাকে ডিহাইড্রেটেড (পানিশূন্য) করে ফেলতে পারে।
২. ঠান্ডা থাকুন- ঢিলেঢালা ও হালকা রঙের পোশাক পরুন। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হবেন না। একান্তই বের হওয়া লাগলে ভারি কাজ এড়িয়ে চলুন, ঘন ঘন বিরতি নিন এবং বিশ্রামের জন্য ছায়া বা শীতল জায়গা খুঁজুন, ছাতা ব্যবহার করুন।
৩. বিপদ চিহ্নগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকুন- তাপ ক্লান্তির লক্ষণ হলো প্রচুর ঘাম হওয়া, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। আপনি যদি এই উপসর্গগুলোর মধ্যে কোনটি অনুভব করেন তবে একটি ঠান্ডা জায়গায় যান, পানি পান করুন এবং বিশ্রাম নিন।
হিট স্ট্রোকের উপসর্গ হলো- শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাওয়া, অসংলগ্ন কথা বলা বা অসংলগ্ন আচরণ করা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। আপনার বা আপনার আশেপাশের কারো মধ্যে এই উপসর্গগুলো থাকলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডিআই/খম