ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে চট্টগ্রামের ৩০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী বিদেশে পালিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সকালে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ৩০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী আবাস গড়েছেন।
এছাড়া আরও অন্তত ২০ জন আছেন যাদের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ না করায় অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এসব ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্য, শিপ ব্রেকিং, গার্মেন্টস, আবাসন, কৃষি ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগের কথা বলে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি।
আত্নগোপনে কতিপয় ঋণখেলাপি
এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার হালিশহর হাউজিং এস্টেটের এল ব্লকের তিন নম্বর সড়কের মৃত বজলুর রহমানের ছেলে মুজিবুর রহমান মিলন। তিনি সিলভিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার ভাই মিজানুর রহমান শাহীনও সিলভিয়া গ্রুপের কর্ণধার। সিলভিয়া গ্রুপের আছে একাধিক সযোগী প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রতিষ্ঠানের নামে দুই ভাই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়েছেন বিদেশে। এর মধ্যে মুজিবুর রহমান মিলন সিঙ্গাপুরে ও মিজানুর রহমান আছেন কানাডায়। তারা ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
এদিকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে আত্মসাতের দায়ে সিলভিয়া গ্রুপের মালিক মুজিবুর রহমান মিলনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই রায়ে আদালত দণ্ডিত আসামিকে ১০০ কোটি ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন। গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুনসী আবদুল মজিদ এই রায় দেন। রায় ঘোষণার সময় মিলনকে পলাতক দেখানো হয়।
আদালতের আদেশে বলা হয়, অগ্রণী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সিলভিয়া গ্রুপের মালিক মুজিবুর রহমান মিলন তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়ে যান। সিঙ্গাপুরে পলাতক মুজিবুর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশের কপি স্বরাষ্ট্র সচিব, অর্থ-সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরে পাঠানো হয়।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দুবাইয়ে বসবাস করছেন ইমাম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী জেবুন্নেসা আক্তার। দুবাই থেকে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপের একাধিক মামলা রয়েছে। গত ২১ মে অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ নির্দেশ দেন।
বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম বলেন, ঋণের বিপরীতে কোনও সম্পত্তি বন্ধক না থাকায় টাকাগুলো আদায় করা যাচ্ছে না। তাই দুবাইয়ে থাকা ওই ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’
আদেশে বিচারক বলেছেন, দেশের অর্থ পাচার করে দুবাইয়ে নানা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন ওই ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রী। তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত চট্টগ্রামে ১৫টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপের অভিযোগে মামলাগুলো করা হয়েছে। ১০ বছর আইনি লড়াই চালিয়েও ওই টাকা উদ্ধার করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজারের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতো তাদের প্রতিষ্ঠান ইমাম ট্রেডার্স। পরে গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয় গার্মেন্টস, যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নানা খাতে। এসব খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বেশিরভাগ বিনিয়োগ হয়েছে জমি কেনায়।
এছাড়া সীতাকুণ্ডের শাহ আমানত আয়রন মার্টের গিয়াস উদ্দিন কুসুম ব্যাংকের ৬০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে ২০১৫ সাল থেকে লাপাত্তা। পাশাপাশি ৫২৫ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে ২০১৭ সালে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন লিজেন্ড হোল্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী এস এম আবদুল হাই।
একইভাবে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে ২০১৮ সালে কানাডায় পাড়ি জমান বাদশা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইশা বাদশা। একই পরিমাণ ঋণ শোধ না করে ২০১৯ সালে বিদেশে পালিয়েছেন নাম করপোরেশনের কর্ণধার আব্দুল আলিম চৌধুরী।
সপরিবারে কানাডা পাড়ি জমানো চট্টগ্রামভিত্তিক বাদশা গ্রুপের কর্ণধার ইসা বাদশাকে ঋণখেলাপি মামলায় বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তার প্রতিষ্ঠানটির কাছে ওয়ান ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ আট ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আটকে আছে বলে জানিয়েছেন আদালত। এসব ব্যাংক ইসা বাদশার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তার কাছে ১০ ব্যাংকের পাওনা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। টাকা আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছেন এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় দেশের শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি নূরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ রতনকে। এর আগে তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তার বিরুদ্ধে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ ছয় হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া চট্টগ্রামের হাবিব গ্রুপের পাঁচ পরিচালক এবং নূরজাহান গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপ, মিসম্যাক গ্রুপ, গোল্ডেন শিপ ব্রেকিং, বনলতা গার্মেন্টস, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, সিঅ্যান্ডএ গ্রুপ, ইফ্ফাত ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কিছু শিল্প গ্রুপের ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তারা বর্তমানে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে ও দুবাইতে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে আদালত সূত্র।
আদালতের পর্যক্ষেণ
সম্প্রতি চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত মামলার আদেশে বলেছেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে আদালতের এখতিয়ারের বাইরে চলে যাওয়ায় এমন বহু সংখ্যক ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থপাচারকারী ও ঋণখেলাপিরা বিদেশে বসে বছরের পর বছর মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পাচ্ছেন।
অন্যদিকে অর্থঋণ আদালত আইনে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা থাকলেও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রমে ব্যর্থ হতে হচ্ছে।
একইসাথে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করার মাধ্যমে এই ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। দীর্ঘ এক যুগ ধরে এই শীর্ষ ঋণখেলাপিরা কোনও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করার কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগ খাতে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নাগরিকদের আমানতের টাকা ঋণের নামে মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতকারীর বিদেশে পাচার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঋণ আদায়ে সংশয় প্রকাশ
ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, আমি বিভিন্ন ব্যাংকের বেশ কিছু ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করছি। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি, কিছু কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়েছেন। এমনকি ঋণখেলাপিদের কেউ কেউ সপরিবারে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। ব্যাংক ঋণ আদায়ে মামলা করলেও টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়ারও উপায় নেই।’
একইভাবে ঢাকা ব্যাংক চট্টগ্রামের আইন কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে ঢাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এসব ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আদালত অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু তারা এবং তাদের পরিবার বিদেশে থাকায় এমনকি আমাদের কাছে ঋণের বিপরীতে কোনও সম্পত্তি বন্ধক না থাকায় টাকা উদ্ধার করতে পারছি না। এসব টাকা উদ্ধার হবে না কিনা, তা নিয়েও সংশয় আছে।