দেশের সকল সরকারি কর্মচারীকে তাদের সম্পদের বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আজ রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে নেওয়া হবে সে বিষয়ে একটি ফরম্যাট প্রস্তুত করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। এরপর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম। দুর্নীতি রোধ এবং চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আচরণবিধিমালায় এমন নিয়ম থাকলেও কাগজের এই নিয়ম মানা হয় না বললেই চলে। এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও অগ্রগতি হয়নি।
সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা আছে। এ অবস্থায় তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পরামর্শ এসেছে। এ জন্য প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে আলোচনা হয়েছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর বিবরণী জমা দেন, যেখানে সম্পদের বিবরণীও উল্লেখ করার বিধান রয়েছে। তাই আলাদা করে পাঁচ বছর পরপর সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার চেয়ে সেটির একটি অনুলিপি বা আলাদা ফরমে জমা দিলেই হবে কি না, সেই আলোচনাও হয়েছিল। এ জন্য বিদ্যমান বিধিমালা সংশোধনেরও উদ্যোগ নিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এখন অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। আচরণ বিধিমালা অনুসারে, নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা। সরকারি চাকরিতে ক্যাডার রয়েছে ২৬টি। এসব ক্যাডার কর্মকর্তা তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করেন। সম্পদের হিসাবও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়েই দেওয়ার কথা। ক্যাডার কর্মকর্তার বাইরেও সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিপুলসংখ্যক নন-ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ও সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাবের বিষয়টি ফের সামনে আসে।
এদিকে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে। বার্লিনভিত্তিক এ সংস্থাটি গত বছর দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করে, সেখানে আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ নিচে নামে বাংলাদেশ। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নিয়মানুসারে প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সরকারি কর্মচারী তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেবেন। আগে তা প্রতি বছর দেওয়ার নিয়ম ছিল। এখন পাঁচ বছরেও অনেকে তা দিতে চান না। তিনি বলেন, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বার্থে এ আচরণবিধি কঠোর ও কঠিনভাবে সরকারের প্রয়োগ করা উচিত। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ভীত হবেন এবং দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
অভিযোগ আছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী তাদের আয়কর রিটার্ন বা এনবিআরে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে প্রকৃত সম্পদ দেখান না; বেনামে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। প্রতিটি আয়কর রিটার্ন ফরমের সঙ্গে আইটি ১০বি নামে একটি আলাদা ফরম থাকে। ওই ফরমেই সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়। সম্পদ বিবরণী জমার তিনটি শর্ত আছে। সে অনুযায়ী সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা পার হলে, গাড়ির মালিক হলে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় জমি-বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক।
একইভাবে মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা দীর্ঘদিন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে প্রার্থী হিসেবে অনেকে যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে তা প্রকাশ করা হয় বটে। তবে সেখানে সম্পদের যে বিবরণ থাকে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।