ইসকন সদস্যদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের জন্য অঝোরে কাঁদছে তার পরিবার ও স্বজনরা। আর ক্ষোভে ফুঁসছে চট্টগ্রামের আপামার জনসাধারণ। উঠেছে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি। উঠেছে জঙ্গি সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধের দাবিও।
মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম আদালত ভবন প্রাঙ্গনে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন আইনজীবীরা। সন্ধ্যায় নামেন বিক্ষোভে। আদালত বর্জন কর্মসূচিও চলছে বুধবার (২৭ নভেম্বর) সকাল থেকে। আলিফ হত্যার বিচারের দাবিতে অব্যাহত রয়েছে এই বিক্ষোভ।
শুধু আইনজীবীরা নয়, এই হত্যাকান্ডের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিএনপি, জামায়াত ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আলিফ হত্যার বিচারের পাশাপাশি তারা জঙ্গি সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাড়িয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে আইনজীবী আলিফের জন্মস্থান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়ও। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভ মিছিলটি উপজেলা সদর বটতলী স্টেশন প্রদক্ষিণ শেষে চৌধুরী প্লাজার সামনে সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুছা তোরাইন ও এইচ এম তামিম মির্জা। তারা ইসকনকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি ও আলিফ হত্যকান্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করে দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
এছাড়া অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে পৃথক পৃথক একাধিক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। দলীয় বা সাংগঠনিক প্রতিবাদ ছাড়াও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে সাধারণ মানুষ আইনজীবী আলিফ হত্যার নিন্দা, বিচার এবং জঙ্গি সংগঠন ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে।
প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে আইনজীবী আলিফের নামাজের জানাজায়। বুধবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বেলা ১১টায় নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে দ্বিতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে এই হত্যকান্ডের তীব্র নিন্দা ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন মুসল্লিরা। জানানো হয় ইসকন নিষদ্ধের দাবিও।
এদিকে বাদ আসর গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ায় তৃতীয় দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আলিফের মরদেহ দাফন করার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ স¤পাদক মো. নাজিম উদ্দিন। তিনি জানান, আইনজীবী আলিফ হত্যায় ক্ষোভে ফুঁসছে চট্টগ্রামের আপামার জনসাধারণ। অন্যদিকে কাঁদছে আলিফের পরিবার ও আত্নীয় স্বজনরা।
তিনি বলেন, আলিফের মা-বাবা ও স্ত্রী শোকে মুহ্যমান হয়ে কারো সাথে কথা বলার অবস্থায় নেই। দেড় বছরের শিশু কন্যা তাসফিয়া বাবা, বাবা বলে এক রুম থেকে অন্য রুমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে আসা নতুন নতুন লোকজনকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে দেখছে। অপরিচিত কেউ কোলে নিতে চাইলে যায় না। আদর করার জন্য কোলে নিতে চাইলেও বলে বাবা আসলে বলে দিব। আর বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলে বাবা শহরে। এখনো সে হয়তো বুঝতে পারেনি, তার বাবাকে সে আর কখনো দেখতে পাবে না। পাবে না বাবার আলিঙ্গন। এদিকে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ইসরাত জাহান তারিন। দেখা হলো না অনাগত সন্তানের মুখও।
সবমিলিয়ে আলিফের বাসায় শোকের এক ভয়াল আবহ বিদ্যমান। নিহত আলিফের স্বজনরা বাড়িতে এসে মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তানকে সান্ত¦না দিতে দেখা গেছে। আলিফ চট্টগ্রামে থাকতেন ব্যাচেলর হিসেবে। পরিবার থাকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদে।
বুধবার সকাল ৮টায় পোস্ট মর্টেমের সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) মর্গের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের বড় বোন জান্নাত আরা বেগম। এতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
ভাই হত্যার বিচার চেয়ে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মঙ্গলবার আছরের সময় একজন খবর দিয়েছে আলিফের যেন কী হয়েছে। আমার মেয়েটা মেডিকেলে পড়ে। আমি ওকে ফোন দিয়ে বলি যে তোমার মামার কী হয়েছে একটু দেখতে যাও তো। পরে মেয়ে আমাকে বলে মা মামা তো আর নেই। এরপর চমেক হাসপাতালে দ্রুত ছুটে যাই। এসে দেখি আমার আদরের ভাইটা আর নেই। কারা মারল আমার ভাইকে। আমরা এর বিচার চাই।
আলিফের ফুফাতো ভাই মহিউদ্দিন জানান, আলিফরা ৫ ভাই ২ বোন। আলিফ মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। ৪ ভাই প্রবাসী। আলিফ প্রায় ৩ বছর আগে উপজেলার সদর ইউনিয়নের দরবেশহাট সওদাগর পাড়ার ইসরাত জাহান তারিনকে বিয়ে করেন। তাদের দা¤পত্য জীবনে দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। আলিফদের পৈত্রিক বাড়ি উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ফারেঙ্গা এলাকায়।
তিনি বলেন, প্রায় ১৫ বছর পূর্বে উপজেলা সদরের দরবেশহাট রোডস্থ টেন্ডল পাড়ায় জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে আসছেন আলিফের পরিবারের সবাই। সেই বাড়িতেই মা-বাবা সাথে স্ত্রী-সন্তানও থাকেন। প্রতি বৃহ¯পতিবার চট্টগ্রাম শহর থেকে লোহাগাড়ায় নিজেদের বাড়িতে আসেন। আর রোববার সকালে কর্মস্থলে চলে যান। আলিফ ছোটবেলা থেকে সাহসী, প্রতিবাদী ও ভালো মনের ছেলে ছিল। তার মামাতো ভাই আলিফ হত্যাকান্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
মঙ্গলবার বিকালে নগরের লালদীঘি এলাকায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় আলিফকে। এ ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনজীবীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া ও হতাশা।