আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইরানের সামরিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকট বিবেচনা করলে দেশটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। গতানুগতিক সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ইরানের রয়েছে আধুনিক ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার। পারমাণবিক সক্ষমতা ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানের জেরে এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। তবে বিশ্বব্যাপী নাগরিক সুরক্ষা বাস্তবায়নে বেশ কিছু দেশ ইরানকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ইরানের সামরিক শক্তির ইতিহাস
১৯৭৯ অভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সামরিক বাহিনী:
ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরানের সামরিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও বেশ কিছু পশ্চিমা দেশের সহায়তা পেতো তারা। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলাভীর শাসনামলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, কার্যকরি প্রশিক্ষণ এবং বিপুল পরিমানে অস্ত্র আমদানির মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে নিজেদেরকে অদ্বিতীয় সামরিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলে। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তির অংশ ছিল দেশটি।
বিপ্লব-পরবর্তী সংস্কার:
১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরানের সামরিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পাহলাভীর শাসননীতি থেকে বেরিয়ে এসে ইরানের সামরিক বাহিনীকে আর্তেশ বাহিনী (ইরানের প্রচলিত সামরিক বাহিনী) ও দ্য ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। গতানুগতিক প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধক্ষেত্রে আর্তেশ বাহিনী কাজ করতো। অন্যদিকে আইআরজিসির কাজ ছিল অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রেখে বিপ্লবের স্পৃহা টিকিয়ে রাখা।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ-পরবর্তী সামরিক অবস্থান:
১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ইরান। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই ইরানের বর্তমান সামরিক অবস্থানের গোড়াপত্তন। পাশ্চাত্যের অস্ত্র সহায়তা বন্ধের পরেও দেশেই আন্তর্জাতিক মানের অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তারা। আধুনিক অস্ত্রের বহর এবং অভিনব যুদ্ধনীতি গ্রহণের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল সামরিক বাহিনী হিসেবে নতুন পরিচয় তৈরি করে দেশটি।
গতানুগতিক সামরিক শক্তি
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইন্ডেক্সের (জিএফপিআই) মতে, ১৮৫টি দেশের মধ্যে ইরানের সামরিক বাহিনীর অবস্থা ১৪তম। দেশটিতে সব মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখ ১০ হাজার সৈন্য সরাসরি কর্মরত।
সেনাবাহিনী: ইরানের সেনাবাহিনীতে তিন লাখ ৫০ হাজার সদস্য রয়েছেন। তাদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর ট্যাংক, গোলাবারুদ ও সাঁজোয়া যান আছে। তবে বেশিরভাগ অস্ত্রই পুরোনো ধাঁচের হওয়ায় এক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান তুলনামুলক দুর্বল।
বিমানবাহিনী: ইরানের বিমানবাহিনীর কার্যক্রম বিপ্লব-পূর্ববর্তী বিমানের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করে। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরণের পুরোনো বিমান বহরের কারণে পিছিয়ে আছে তারা। তবে এই দুর্বলতা কাটাতে সম্প্রতি তারা আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে।
নৌবাহিনী: পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালি অঞ্চলের সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকে ইরান নৌবাহিনী। এই প্রচেষ্টায় তারা সাবমেরিন ও মাইনবোমা ব্যবহার করে থাকে।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ইরানের প্রভাব:
ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রভাব ইরানের অভ্যন্তরীণ পরস্থিতি ছাপিয়ে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইরাকের শিয়া সম্প্রদায় এবং ইয়েমেনের হুতি সম্প্রদায়কে সরাসরি সহায়তা করে আইআরজিসি। এ ছাড়া ইসরায়েল ও সৌদি আরবের বিরোধ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সংগঠনটি কাজ করে।
ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা:
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী ইরান। আধুনিক ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দেশটির সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড। ছোট ও মধ্যম আকারের ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্য নির্ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে তৎপর ইরান। নির্ভুলভাবে শত্রুর ঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার কার্যকর ও সমৃদ্ধ করাই এই প্রযুক্তির উদ্দেশ্য।
এ ছাড়া প্রচণ্ড শক্তিধর স্পেস লঞ্চিং ভেহিকলস (এসএলভি) রয়েছে ইরানের। বিরোধীপক্ষের দাবি, ইরান এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে। গতানুগতিক সামরিক খাতের দুর্বলতা কাটাতেই ইরান এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। আক্রমণ ঠেকিয়ে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ইরানের পরমাণু খাত:
পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক অবস্থান নিয়ে অনেকদিন যাবৎ আপত্তি জানিয়ে আসছে। বর্তমানে তাদের অস্ত্রের বহরে পারমাণবিক বোমা না থাকলেও প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম মজুদের পাশাপাশি কাঠামোগত পরিবর্তন পারমাণবিক খাতে দেশটির সম্ভাব্য সংযোজনের বার্তাই দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের যে পরিমান কাঁচামাল রয়েছে, সরকার নির্দেশ দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম তারা।
পরমাণু নীতি:
ইরানের দাবি, তাদের পরমাণু খাতের উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়ন। তবে অতীতে বিভিন্ন গোপন গবেষণা ক্ষেত্রে জড়িত থাকার কারণে ইরানের পরমাণু নীতি আন্তর্জাতিক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া তাদের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনকারীদের প্রবেশ করতে না দেওয়ায় এই খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা তৈরি না করলেও যেকোনো সময় বানানোর সক্ষমতা রাখে। পরমাণু প্রত্যাহার চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও পারমাণবিক অস্ত্রের কাঁচামাল মজুদ করার বিষয়কে ঘিরে ভূরাজনৈতিক চাপে আছে দেশটি।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:
ইউরেনিয়াম মজুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রভাব আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে স্পষ্ট। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে রাজনৈতিক স্থিরতার ওপর বিরাট হুমকি বলে বিবেচনা করে। সম্প্রতি ইসরায়েলে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ভঙ্গুর কূটনৈতিক পরস্থিতির দিকেই ইঙ্গিত করছে।
ইসরায়েলের আত্মনির্ভরশীলতা:
কয়েক দশক ধরেই আন্তর্জাতিক মহলের বিরোধের কারণে ইরান দেশেই সামরিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে বাধ্য হয়েছে। ড্রোন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশটি উল্লেখযোগ্য আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করেছে। তবে, রাশিয়ার সঙ্গে জোট গঠনের মাধ্যমে কিছুটা সামরিক সহায়তা পাচ্ছে দেশটি। বিশেষত, ড্রোন প্রযুক্তি ও সামরিক প্রশিক্ষণে রাশিয়ার সহায়তায় আধুনিকায়ন নিশ্চিত করছে ইরানের সামরিক বাহিনী।
সামরিক খাতে বাধা:
ইরানের সামরিক বাহিনী যথেষ্ট সক্ষম হলেও কিছু ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পুরোনো প্রযুক্তির অস্ত্রের বহর তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ১৯৭৯ পূর্ববর্তী অস্ত্র ব্যবহারের কারণে সামরিক খাতে বিরোধীশক্তির চেয়ে পিছিয়ে ইরান। অর্থনৈতিক টানপোড়নের কারণেও ইরানের সামরিক সক্ষমতা কিছুতা ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে সৌদি আরব, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্বের কারণে সামরিক সম্ভাবনা পূরণ করতে পারছে না এই দেশটি।
তবে সব বিপত্তি পেরিয়ে নিজেদেরকে শক্তিধর সামরিক অবস্থানে নিয়ে গেছে ইরান। গতানুগতিক সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অভিনব যুদ্ধনীতি ও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ব্যবহার দেশটির সামরিক খাতকে আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ইরানের কূটনৈতিক অবস্থানের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট অনেকাংশেই নির্ভর করছে। তবে ভৌগলিক সহিংসতা নিরসনে কূটনৈতিক প্রতিহিংসা সরিয়ে ইরান মানবিক অবস্থান নিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা।
সূত্র: গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইন্ডেক্স (জিএফপিআই), ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি, কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস (সিএফআর), সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)।