চলমান ভয়াবহ তাপপ্রবাহে অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মানুষ। গত চার-পাঁচ দিন ধরে মানুষের সাথে হাঁসফাঁস করছে পশু-পাখিরাও। এর মধ্যে চলছে তীব্র লোডশেডিং ও ওয়াসার পানির সংকট। ভোগান্তি বেড়েছে চলমান এস এস সি ও আসন্ন এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদেরও। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুরা।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ মোখার প্রভাবে এই গরম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, গরম আরও আগামী ৩ দিন থাকবে। কারণ এ সময়ে আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে। অর্থাৎ ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ মোখার প্রভাবে এই তীব্র গরম অনুভুত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে এটি আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে জ্বলীয় বাস্প শোষন করে শক্তি অর্জন করে। ফলে এসব এলাকায় তীব্র গরম অনুভুত হয়। দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি আরও শক্তি বাড়িয়ে আজ বা কাল ঘুর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এর অবস্থান, গতি-প্রকৃতি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্কবার্তা জানানো হবে।
ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, মঙ্গলবার বিকালে নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর বুধবার ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে ওই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র। প্রথম দিকে উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেও ১২ মে ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
খরতাপে দিশেহারা মানুষ :
এদিকে তাপদাহের কারণে চট্টগ্রামের রাস্তায় হাটাচলা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের আনাগোনা কমেছে। গাছের নিচে বা ভবনের নিচে বসলেও মানুষ শুধুই ঘামছে আর ঘামছে। সড়কে কুকুরগুলোকেও দেখা যাচ্ছে পানির সন্ধান করতে। বনের পশু-পাখিরাও পানির সন্ধানে লোকালয়ে ছুটছে। তৃষ্ণার্ত পাখিরা ধরা দিচ্ছে দালানের ব্যালকনিতে। যানবাহন রাস্তাঘাটে মানুষের হাহাকার। কোথাও যেন স¦স্তির অবকাশ নেই। রাস্তাঘাটে দিনমজুর শ্রমিকেরা ধুঁকছেন। অঝোরে ঝরতে থাকা ঘাম প্রশমিত করতে কেউ ঢালছেন মাথায় পানি, কেউ বা বারবার গামছায় মুছে নিচ্ছেন ঘাম। গরমের তীব্রতা এতোটাই বেশি যে, মানুষ কিছুতেই পেরে উঠছেন না। গরমের সঙ্গে শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা রকম রোগ বালাইও। প্রায় অনেকের জ্বর সর্দি কাশি ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগ দেখা দিচ্ছে। এসব জ্বর কাশি সহসা সারছেও না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক নূর নাহার বলেন, বিশেষ করে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস বি ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বুধবার (১০ মে) সকাল থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুধু ডায়রিয়া রোগীই ভর্তি হয়েছে প্রায় ১১০ জন। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আব্দুর রব বলেন, প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। সেই সাথে সিভিয়ার ডিসেন্ট্রি দেখা দিচ্ছে। বাইরের খাবার খাওয়ার কারণে টাইফয়েড ও ডিসেন্ট্রি দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগই বাইরের শরবত খাওয়ার কারণে হচ্ছে। সুতরাং বাইরের খাবার পরিহার করতে হবে। গরমের এসব রোগ প্রতিহত করতে বেশি বিশুদ্ধ পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। সুতির কাপড় চোপড় পরিধান করতে হবে। বাইরে বের হলে ক্যাপ, ছাতা এসব ব্যবহার করতে হবে। গরমে সবচেয়ে উপকারী রাইস স্যালাইন। আর অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ :
এদিকে অসহ্য গরমের মধ্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। কাহিল হয়ে পড়েছেন এস এস সি পরীক্ষার্থীরাও।
চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এস এস সি পরীক্ষার্থী সোহেল আকবর বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে পরীক্ষার হলের বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ থাকে। এ সময় গায়ের ঘামে পরীক্ষার খাতা ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি সঠিকভাবে উত্তর লেখাও সম্ভব হয় না। গরমে মাথা ঘুরানি শুরু হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম সরকারি বলিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এস এস সি পরীক্ষার্থীর বাবা আমিনুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রে মেয়েকে সাথে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রে কোথাও বসার বা দাড়ানোর মত জায়গা নেই। কড়া রোদে সড়কে দাড়িয়ে থাকতে হয়্ এ অবস্থায় ঘেমে গিয়ে অনেক মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
আরেক পরীক্ষার্থীর মা শর্মিলা দে বলেন, একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে লোডশেডিং ঘরে-বাইরে কোথাও টেকা যাচ্ছে না। ছেলে-মেয়েরা কেন্দ্রে যেমন ঘামে, বাসায়ও তেমন ঘামে। পড়ালেখা ঠিকমতো করতে পারছে না। তাই অনেকের পরীক্ষা ভাল হচ্ছে না।
শুধু এস এস সি নয়, আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও একই দশায়। লোডশেডিংয়ের কারণে নগরীর ঘরবাড়িতে হাহাকার শুরু হয়েছে। নগরবাসীর অভিযোগ, চট্টগ্রামে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র গরমের মধ্যে লোডশেডিং অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে সবখানে। দুই ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং দেয়া হয়, প্রতিবার লোডশেডিংয়ে কমপক্ষে একঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। এমনকি রাত গভীরেও লোডশেডিং দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গ্যাস সংকটের সুরাহা এবং ভারি বৃষ্টিপাত না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
পিডিবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রামে ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তার তুলনায় ২৫০-৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য সূচি মেনে লোডশেডিং করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বৃষ্টির অভাবে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ। জ্বালানি সংকটের কারনে অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে চাহিদাও কিছুটা কমবে। তখন লোডশেডিং পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানান তিনি।
চলছে পানির জন্য হাহাকার :
দাবদাহ এবং লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি নগরবাসীকে পানির জন্যও হাহাকার করতে হচ্ছে। পানি উৎপাদন কমে যাওয়ায় নগরবাসী প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না। লবণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ওয়াসার পানি উৎপাদন বহুলাংশে কমে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান একে এম ফজলুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রামে দৈনিক ১৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন কমেছে। ভারি বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কাপ্তাই লেক থেকে পানি প্রবাহ না বাড়লে লবণের তীব্রতা কমবে না। এমতাবস্থায় পানির উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না। তবে ওয়াসা ডিপ টিউবওয়েল থেকে পানি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
এদিকে নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক বি ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, একদিকে গরম, অন্যদিকে ভয়াবহ লোডশেডিং ও পানি সংকটের কারণে জীবনযাপন করা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। সে পড়তে পারছে না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরীক্ষায়। এতো এতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? আবার পানির অভাবে গোসল করা কাপড়-চোপড় ও ঘরের হাড়ি পাতিল পর্যন্ত ধোয়া যাচ্ছে না। ত্রিমুখী সংকটে যেন বিপর্যন্ত চট্টগ্রাম।