বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

হালদায় মাছের ডিম সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তিত জেলেরা

print news

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীতে এ পর্যন্ত তিন দফা নমুনা ডিম ছেড়েছে রুই বা কার্প জাতীয় মা মাছ। আসন্ন অমাবস্যার জোতে পুরোপুরি ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন জেলেরা। তবে এই ডিম সংরক্ষণ নিয়েও চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

জেলেদের অভিযোগ, যথাযথ পরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সংগ্রহকৃত মা মাছের ডিম প্রতিবছরই নষ্ট হয় বিপুল পরিমানে। যার মূল্য কোটি কোটি টাকা। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তা-ব্যক্তিদের গাফিলতি আর গা-ছাড়া ভাবকেই দায়ী করছেন তারা।

জেলেরা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও হালদা নদী থেকে রুই বা কার্প জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হালদা পাড়ের সহস্রাধিক জেলে। কিন্তু এই ডিমের রেণু ফোটানো নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন জেলেরা। কারণ ডিমের রেণু ফোটানোর জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় ৪টি করে মোট ৮টি সরকারি হ্যাচারি রয়েছে।

এরমধ্যে বর্তমানে মোবারকখিল এলাকার হ্যাচারিটি চালু থাকলেও ছিপাহিরঘাট নিউ হ্যাচারি, মঘাশাস্ত্রি ও কাগতিয়া সুইচ গেট হ্যাচারি অকেজো পড়ে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। অন্যদিকে হাটহাজারীর ৪ টির মধ্যে গড়দুয়ারা হ্যাচারি হালদার ভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গেলেও বড়ুয়া পাড়া, শাহমাদারী, ও মাছুয়া ঘোনা হ্যাচারি চালু আছে। অন্যদিকে হালদার মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কাজে থাকা এনজিও সংস্থা আই.ডি.এফ হালদা প্রকল্পের আওতায় রাউজানের গড়দুয়ারা অংশের চিপাহীঘাট এলাকায় একটি হ্যাচারি আছে।

জেলেরা জানান, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই হ্যাচারি সরকারি হ্যাচারিগুলোর তুলনায় বেশ পরিপাটি, ব্যবস্থাপনাও সন্তোষজনক। প্রতিবছর প্রায় ৩০ জন ডিম সংগ্রহকারী এই হ্যাচারিতে ডিম ফোটানোর সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রায় দেড়শ কেজি ডিম থেকে রেণু ফোটানোর ব্যবস্থা আছে এই হ্যাচারিতে। উক্ত হ্যাচারিতে প্রতিবার ডিম ফোটাতে চৌবাচ্চা প্রতি ১ হাজার টাকা করে দিতে হয় আইডিএফকে।

একইভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হ্যাচারিতে বিনামূল্যে ডিম ফোটানোর কথা থাকলেও প্রজনন মৌসুমে চৌবাচ্চা প্রতি ১ হাজার টাকা করে দিতে হয় জেলেদের। কিন্তু সরকারি হ্যাচারির বেহাল দশার কারণে হালদা থেকে বেশিরভাগই জেলেই প্রাচীন পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে মাটির কুয়া তৈরি করে তাতে ডিম সংরক্ষণ করে রেণু ফোটান। এ পদ্ধতিতে জেলেরা কুয়ায় নদীর ঘোলা পানিতে ডিম সংরক্ষণ করেন। রেণু ফোটার পরে ৪ দিন এই রেণুগুলোকে এক কুয়া থেকে অন্য কুয়াতে সুতি কাপড়ে নদীর পানি দিয়ে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তরের সময় অনেক রেণু মারা যায়। রাউজান-হাটহাজারী উপজেলার হালদা পাড়ে বর্তমানে প্রায় ৬০টি মাটির কুয়া আছে।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

হালদা নদী ঘিরে হ্যাচারির অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে হালদা গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, হালদা নদী থেকে প্রতিবছর এক থেকে দেড় হাজার কেজি পর্যন্ত কার্প জাতিয় মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। এসব ডিম থেকে ফোটানো প্রতিকেজি রেণুর দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক কেজি ডিম থেকে আনুমানিক ৩ কেজি পর্যন্ত রেণু হয়ে থাকে। সে হিসেবে এই ডিম থেকে শত কোটি টাকার সম্পদ আহরণ করা হয়। তম্মধ্যে কোটি কোটি টাকার রেণু ফোটানোর পর যখাযথ সংরক্ষণের অভাবে মারা যায়। যা দেশের অর্থনীতর জন্য বড় ধরণের ক্ষতি।

তিনি বলেন, একটা হ্যাচারি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হয়। যেমন চৌবাচ্চাতে ডিম রাখার পর যে পানিগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলো অবশ্যই পুকুরের পরিষ্কার পানি হতে হবে। কিন্তু আমার জানা মতে মদুনাঘাট হ্যাচারি ছাড়া বাকি হ্যাচারিগুলোর একটিতেও পুকুর নেই। নদীর ঘোলা ও অপরিষ্কার পানি চৌবাচ্চাতে দেওয়া হয়। যার কারণে বেশিরভাগ ডিমই নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণে প্রতিটি হ্যাচারিতে পুকুর থাকা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘বছরের অন্যান্য সময় হ্যাচারিগুলো থাকে অযত্ন–অবহেলায়। এসব দেখভালের জন্য কোনো লোকই থাকে না। শুধুমাত্র প্রজনন মৌসুমে কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এতে ডিম ফোটার পরিবেশ তৈরি হয় না। এককথায় মদুনাঘাট হ্যাচারি ছাড়া বাকি একটা হ্যাচারিও গুণগত মানের না। মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। কিন্তু তারা যদি নিজেদের কাজ ঠিকমতো না করে তাহলে আমি-আপনি তো কিছু করতে পারবো না। এসব বিষয়ে নজরদারির পাশাপাশি জেলেদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

হালদা নদীতে প্রায় ৩৫ বছর ধরে ডিম সংগ্রহ করে আসছেন কামাল সওদাগর। তার মতে, ডিম সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিম নষ্ট হয়, ডিম থেকে রেণু ফোটার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণের সময়। এক্ষেত্রে তিনি সরকারি হ্যাচারির নানামুখী অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি হ্যাচারির সংখ্যা খুব কম। তাছাড়া সরকারি হ্যাচারি বেশিরভাগ সময়ই থাকে অপরিচ্ছন্ন ও ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। যার কারণে মাছের ডিম রেণুতে পরিণত হওয়ার আগেই কিছু কিছু সরকারি হ্যাচারিতে মারা যায়। অতীতে এ কারণে অনেক ডিম সংগ্রহকারী জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডিম সংগ্রাহক কামাল বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে হ্যাচারিতে ডিম ফোটালে ভালো ফলাফল পাওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। হ্যাচারিতে ডিম ফুটে বের হওয়া পোনা বেশ দুর্বল হয়, ফলে পুকুরে ছাড়লে তার বেশিরভাগই মারা যায়। কিন্তু মাটির কুয়াতে সংরক্ষণ করা ডিম থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ পোনা পাওয়া যায়। সেসব পোনা দ্রুত বর্ধনশীল ও শারীরিক গঠন ভালো হয়। অন্যদিকে কৃত্রিম কুয়ার পোনার বৃদ্ধি অনেক কম। তাই এবারও ডিম সংগ্রহ করার প্রস্তুতিতে থাকা বেশিরভাগ জেলেই মাটির কুয়া তৈরি ও আগের কুয়া সংস্কার করেছেন।’

হ্যাচারির অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহিদুল আলম বলেন, ‘হ্যাচারি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মৎস্য বিভাগের। তবে গত বছর থেকে সরকারি হ্যাচারিগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব ইউএনও–কে দেওয়া হয়েছে। তারপর আমি নিজে জেলে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, সাবমার্সিবল পাম্প বসানো, চৌবাচ্চা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাসহ হ্যাচারিকে ব্যবহার উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিয়েছি। যার কারণে জেলেরা অন্যান্য বারের তুলনায় এবার পোনার সংগ্রহ ও সংরক্ষণে বেশি সুফল পাবেন।’

হালদা গবেষকদের মতে, ২০২০ সালে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণার সময় হালদায় মাছ এবং জলজ প্রাণী শিকার করা যাবে না এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। মৎস্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রজনন মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে শুধুমাত্র মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করার কথা থাকলেও মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্বিকার ভূমিকায় এই নির্দেশনা অমান্য করে চলছে চিংড়ির পোনা শিকার। এভাবে প্রতি বছর মার্চ-জুন এই ৪ মাস গলদা রেণুর সাথে আসা হালদা নদীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মাছের পোনাও নষ্ট হচ্ছে। এসব ঘটনায় হালদা নদীর চিংড়ির অপার সম্ভাবনা ধ্বংস হচ্ছে।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

হালদা গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হালদা নদীতে মা মাছের আহরিত ডিমের মত বর্ষা মৌসুমে ঐ ডিমের পাশাপাশি চিংড়ি পোনা আহরণ করে যদি সংরক্ষণ করা হয়, অথবা শীত মৌসুমে মিহি সূতার জাল টেনে চিংড়ি পোনা আহরণ করা, খুবই সহজ। এ পোনা বিক্রি করে পুকুর-দীঘিতে অবমুক্ত কিংবা পোনা বিক্রি করে মোটা অংকের রাজস্ব আয় সম্ভব। এটিও দেশের একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। কিন্তু কার্পজাতীয় মাছকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সম্ভাবনাময় এই খাতকে গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা মৎস্য বিভাগসহ হালদা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

হ্যাচারির অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘সরকারি হ্যাচারিতে ডিম ফোটার সাফল্যের হার বেশি হওয়ায় প্রায় সবাই এখানে ডিম ফোটাতে চায়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় সবাইকে আমরা হ্যাচারি ব্যবহারের সুযোগ দিতে পারি না। আগে থেকেই আগ্রহীদের নিয়ম অনুসরণ করে বরাদ্দ দিতে হয়। তারপরও এমন অভিযোগ আসলে কী করার আছে বলুন। আমি মনে করি যারা এসব অভিযোগ করছে তাদের সরকারি হ্যাচারি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।’

অবাধে চিংড়ির পোনা ধরার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে হালদা কার্পজাতীয় মাছের অভয়াশ্রম। চিংড়ি কিংবা অন্যান্য মাছের জন্য হালদা কিন্তু অভয়াশ্রম না। তাই আমাদের প্রধান টার্গেট কার্পজাতীয় মাছ। যদিও হালদায় যেকোনো মাছ ধরা নিয়মবহির্ভূত। তারপরও স্থানীয় জেলেরা ঠেলাজাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরে থাকেন। প্রথমত লোকবল সংকট, দ্বিতীয়ত দীর্ঘ হালদায় কখন কে, কোথায় চিংড়ি মাছ ধরছে তা পাহারা দেওয়াও কষ্টসাধ্য। তবে মাছ ধরা বন্ধ করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।’

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page