চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এখনো বেসামাল পেঁয়াজ রসুন আদাসহ গরম মসল্লার বাজার। বাজার নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন অভিযানও চালিয়েছে। তাতে রসুন ও আদার দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম পাইকারি কেজিপ্রতি রয়ে গেছে ৭৫-৮০ টাকা।
মঙ্গলবার (২৩ মে) সকালে দেশের পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে ব্যসায়ীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জে বর্তমানে পেঁয়াজ পাইকারি হিসেবে প্রতিকেজি বিক্রয় হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। যা খুচরা বাজারে বিক্রয় হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়।
কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার পথে যা প্রতিকেজি বিক্রয় হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। অথচ রমজানের ঈদের আগে এই পেঁয়াজ প্রতিকেজি ২৫-২৮ টাকায় বিক্রয় হয়েছিল। খুচরা বিক্রয় হয়েছিল ৩২-৩৫ টাকা কেজি দরে। আর ঈদের এক সপ্তাহ পর হঠাৎ পেয়াজের দাম বেড়ে যায়।
একইভাবে আদার দামও বেড়ে ৩৬০ টাকা কেজি পর্যন্ত হয়ে যায়। তবে সোমবার (২২ মে) থেকে আদার দাম কমে কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা বিক্রয় হচ্ছে। অথচ রমজানের সময়ও প্রতিকেজি আদা বিক্রয় হয়েছিল ১০০-১২০ টাকা দরে। এদিকে অনেকটা কমেছে রসুনের দাম। রসুন এখন বিক্রয় হচ্ছে প্রতিকেজি ১৩০ টাকা দরে। সোমবারের আগে এই রসুন বিক্রয় হয়েছে কেজিপ্রতি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। এই সময়ে মিয়ানমারের রসুন বিক্রয় হয়েছে ২০০ টাকা কেজি দরে।
আদা-রসুনের দাম কিছুটা কমলেও বাজার এখনো বেসামাল বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবি, আমদানিকারদের ডিও সিন্ডিকেটের কারণে ঈদের পরে হঠাৎ ভোগ্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। আর জেলা প্রশাসেনর অভিযানে ডিও সিন্ডিকেট শনাক্ত হওয়ার পর দাম কিছুটা কমেছে। এরপরও এই দাম ভোক্তা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে বলছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজীর দেউরি বাজারের শাহ আমানত স্টোরের মালিক জাহাঙ্গির আলম বলেন, দাম বাড়ার কারণে পেঁয়াজ আদা রসুন বিক্রয় কমে গেছে। ক্রেতারা দাম বাড়ার আগে যেখানে পেঁয়াজ এক কেজি কিনেছে সেখানে এখন কিনছে আদা কেজি, ২৫০ গ্রাম। রসুন কিনছে ১০০ গ্রাম। আদা তা কিনছেই না। শুধুমাত্র বিত্তবানরাই এখন আদার ক্রেতা।
জানতে চাইলে নগরীর চকবাজারের ভাই ভাই স্টোরে ভোগ্যপণ্য কিনতে আসা নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, বাজারে তেল, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও গরম মসল্লাসহ সবকিছুর দাম বেশি। যা কিনতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে এসব পণ্য কেজি হিসেবে কেনার কথা ভুলে গিয়ে গ্রাম হিসেবে কিনতে হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে মনে হয় দেশে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ চলছে।
ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ খাইরুজ্জামান বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের টিম নিয়মিত মনিটরিং করছে। এরমধ্যে এই গত রবিবার জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এ সময় আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ডিও সিন্ডিকেটের ৬০০ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। যাদের নামের তালিকা ও মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করা হয়েছে। বিষয়টি প্রকাশের পর তাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে তাদের মোবাইল ফোন। ফলে বাজারে এখন আদা-রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম কমে এসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের টিম ডিও সিন্ডিকেটের দালাল ও আমদানিকারদের কারসাজির বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, আমরা বরাবরাই বলে আসছি সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে ভোগ্যপণ্যের বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও সংকটের কারণে আমদানি বন্ধ রাখাসহ যেসব কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন তা অজুহাত মাত্র। দাম বৃদ্ধির পেছনে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজিই মূল দায়ী। যা জেলা প্রশাসনের একটি কার্যকর অভিযানের পর প্রমাণ হয়েছে। আদা ও রসুনের দাম অর্ধেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি না হলে দেশের বাজারে পেঁয়াজ রসুন আদা, গরম মসল্লার সংকট হত। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। সমস্যা শুধু আকাশছোঁয়া দাম। টাকা দিলেই যত পণ্য দরকরার তত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। একটা বিষয় মানতে হয় ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কিছুটা বেড়েছে। তবে বিশ্ববাজারে যেহারে বেড়েছে দেশে তো তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এটা কি আমদানিকারকদের কারসাজি নয়-প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আতিক উল্লাহও বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কারণ চলতি বছর ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। বিপরীতে দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।
এরপরও ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টান। এর মধ্যে ৩০-৩৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে ১৮-২০ টাকায় কিনে মজুত করা পেঁয়াজ ৮০-৮৫ টাকা বিক্রয় করা এবং আমদানি বন্ধ রাখার অজুহাত উপস্থাপন করা অমুলক। গত তিন অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করার পরও পেঁয়াজের দাম কম ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যে অসৎ লোকের প্রবেশ ঘটেছে। এই কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক।
তিনি জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৪২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
টিসিবির তথ্যমতে, দেশে বছরে রসুনের চাহিদা প্রায় ৯ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৪৩ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রসুন আমদানি হয়েছে ৫২ হাজার ৪৬১ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে রসুন আমদানি হয়েছে ৮২ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৬৯ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বছরে তিন লাখ টন আদার চাহিদা রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন আদার উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৮২ হাজার টন। বাকি আদার চাহিদা মেটানো হচ্ছে আমদানি করে। মিয়ানমার, ভারত ও চীন থেকে আদা আমদানি করা হয়। তবে রমজানের ঈদের আগে চীন থেকে আদা আমদানি বন্ধ থাকায় খাতুনগঞ্জের বাজারে আদার দাম বাড়তির দিকে ছিল। ঈদের পরে আমদানি শুরু হলেও আদার দাম আর কমেনি। বরং আদার কেজি বেড়ে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। যা বর্তমানে কমে ২৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।
এদিকে হু হু করে বাড়ছে গরম মসল্লার দামও। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের বৃহত্তর ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে রোজার আগেও ৩২০ টাকায় প্রতিকেজি জিরা বিক্রি হয়েছিল। রোজার মধ্যে পণ্যটির দাম বেড়ে বিক্রি হয়েছিল ৬৫০ টাকায়। বর্তমানে প্রতিকেজি জিরার দাম ঠেকেছে ৭৫০ টাকায়।
একইভাবে প্রতিকেজি ধনিয়ার দাম বেড়ে এখন ২০০ টাকা, গোল মরিচ ১ হাজার টাকা, দারুচিনি ৫৭০ টাকা, তেজপাতা ২০০ টাকা টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি সরিষা ৩০০-৩৫০ টাকা, মেথি ১২০-১৬০ টাকা, আলু বোখারা ৪৮০-৫০০ টাকা, কিশমিশ ৪৪০-৪৬০ টাকা, কাঠবাদাম ৭৪০-৭৬০ টাকা, কাজু বাদাম ৮২০-৯৫০ টাকা, পেস্তা ২৬৬০-২৭৫০ টাকা ও পাঁচফোঁড়ন ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লবঙ্গ-এলাচের দাম। প্রতিকেজি লবঙ্গ ৩০০ টাকা ও এলাচ ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি এলাচ ২৬০০ টাকা ও লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা জানান, হলুদ, মরিচ, মেথি, কালিজিরা, তেজপাতা, আদা, রসুন, সরিষা, পেঁয়াজ, ধনিয়াসহ অধিকাংশ মসলার বাজার আমদানি নির্ভর। এসব মসলার কিছু অংশ দেশে উৎপাদিত হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। তাই দেশের মসলা বাজার ৮০ ভাগই বিশ্ববাজারের উপর নির্ভরশীল।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেটের সাধারণ স¤পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, আমাদের দেশে চীনের আদা ও রসুনের চাহিদা বেশি। কিন্তু বর্তমানে সেখানে বুকিং রেট দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই দুই পণ্য টনপ্রতি দুই হাজার ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। বুকিং রেট বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকরাও বিপাকে পড়েছেন। পাশাপাশি আমাদেরকে এখন শুধুমাত্র দেশি পেঁয়াজের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাই দাম বেড়ে গেছে। তবে সরবরাহ বেড়ে গেলে মসলার দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।