চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনা এলাকায় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের গড়ে তোলা আবাসিকে যাতায়াতের জন্য এডিবির অর্থায়নে রাস্তা নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় যেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর এই রাস্তা নির্মাণে পাহাড় কেটে সাবাড় করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রকল্পের এই রাস্তা নির্মাণের নামে ইতোমধ্যে আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনা এলাকার অন্তত ৫টি পাহাড় কাটা হয়েছে। পাহাড় কাটার সময় মাটি ধসে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় পরিবেশ অধিদফতর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা একাধিক মামলা করলেও থামছে না পাহাড় কাটা। কারণ পাহাড় কাটার মূল হোতা কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম ধরা-ছেঁয়ার বাইরে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, রাস্তা নির্মাণে বেলতলী ঘোনা এলাকায় পাহাড় কাটার সময়গত ৭ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় উপর থেকে মাটি ধসে পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সেই স্থান থেকে একটু দূরেই লেকসিটি এলাকার কাছে কালিরছড়া ভরাট করে ৯নং পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিমের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। সেই আবাসিক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে বেলতলী ঘোনা এলাকায় রাস্তা নির্মাণ করছে চসিক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশনের অধীনে এডিবির অর্থায়নে ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় প্রতিরোধ দেয়ালসহ ওই এলাকায় রাস্তার নির্মাণকাজ চলছে। রাস্তার নির্মাণে পাহাড়ের পাদদেশ সমান করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু রাস্তাটি কেন নির্মাণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি একটি উন্নয়ন প্রকল্প, সেটি তো বুঝতে হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ওমর ফারুকের বক্তব্য, বেলতলী ঘোনার যেখানে পাহাড়ধস হয়েছে, তার সামনে অন্তত পাঁচটি পাহাড় রয়েছে। স্থানীয় সরকার, রেলওয়ে ও শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন এসব পাহাড়। পাহাড়ে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে পাহাড় কেটে বসতি এবং মাটি বিক্রি করা যায়।
এ বিষয়ে পাহাড় খেকোদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বললেন সীতাকুণ্ড (বেলতলী ঘোনা তাঁর নির্বাচনী এলাকার অংশ) থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ দিদারুল আলম। এতে পাহাড় কাটার মূল উদ্দেশ্য ও জড়িতদের মুখোশ বেরিয়ে আসবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেন বলেন, বেলতলী ঘোনার মাঝখান দিয়ে রাস্তা নির্মাণে অন্তত পাঁচটি পাহাড় কাটা হয়েছে। এই রাস্তা নির্মাণ হলে পুরো পাহাড় সাবাড় হয়ে যাবে। কাউন্সিলর জসিমের সাম্রাজ্য বাড়ানোর অংশ হিসেবে এই রাস্তা করা হচ্ছে। এই জসিমের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনেই তিনটি মামলা ও বেশ কয়েকটি নোটিশ রয়েছে। কিন্তু তার মাথার উপর প্রভাবশালীদের হাত থাকায় তিনি এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ফলে তিনি বেপরোয়াভাবে পাহাড় কেটে সাবাড় করছেন।
বেলতলী ঘোনা সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মানিক জানান, যেসব পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হচ্ছে, সেসব পাহাড়ের মালিক অগ্রণী ব্যাংক অফিসার্স কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি। পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিক আবেদন জমা পড়েছে প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে। অগ্রণী ব্যাংক অফিসার্স কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি এসব আবেদন দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতা মোহাম্মদ আবুল কালাম।
তিনি বলেন, আমরা তো অভিযোগ করেছি। সেগুলোর কোন একশান হয়নি। পাহাড় কাটার সময় মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছেন। পরিবেশ অধিদফতর মামলা করেছেন। সরেজমিনে পাহাড় কাটা দেখতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আকবর শাহ থানায় জহুরুল আলম জসিমকে আসামি করে মামলা করেছেন। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। তিনি পাহাড় কেটেই চলেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মোহাম্মদ জহুরুল আলম জসিম ক্ষিপ্ত হয়ে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করেন। তিনি বলেন, কোন চোদানির পোয়ায় কই আমি পাহাড় কাটছি। তাকে আমার সামনে নিয়ে আসেন। পাহাড় কি আমার বাপের? পাহাড় আমি কাটব কেন? সিটি করপোরেশনের প্রকল্প বাস্তবায়নে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য সামান্য মাটি খোঁড়া হয়েছে। এটা ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সিটি করপোরেশনের একটি প্রকল্প। এতে আমার কোন হাত নেই।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ এবং খালের ওপর নির্মিত কাউন্সিলর জসিমের খামার পরিদর্শনে গেলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় তিনি নগরীর আকবর শাহ থানায় মামলা দায়ের করেন।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কিছুই হয়নি জসিমের। দেশের আইন এত দুর্বল নয় যে, একজন পাহাড়খেকো কাউন্সিলরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। দুর্বলতা হচ্ছে প্রশাসনের।’ কাউন্সিলর জসিমের সাথে একাধিক প্রভাবশালী লোক রয়েছে। যারা আড়াল থেকে জসিমকে রক্ষা করছে।