চট্টগ্রামে এবার কোরবানিযোগ্য গবাদি পশু মজুদ আছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৯৩০টি। কিন্তু কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭১৩টি। অর্থাৎ এক লাখেরও বেশি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে। যা দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা গবাদি পশুতে পুরণ হবে।
সোমবার (১২ জুন) এ তথ্য জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এবার গত বছরের তুলনায় কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর চাহিদা অন্তত ৫০ হাজারের চেয়েও বেশি। অথচ এবার গত বছরের তুলনায় ৫০ হাজারের মতো গবাদি পশু কম উৎপাদন হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় এক লাখেরও বেশি গবাদি পশুর ঘাটতি তৈরী হয়েছে। তবে এ ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। কারণ প্রতিবছর কোরবানির সময় দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে এক লাখেরও বেশি গবাদি পশু আসে চট্টগ্রামের বাজারে।
তিনি জানান, এবারের কোরবানিতে চট্টগ্রাম জেলায় ১৫টি উপজেলা এবং চট্টগ্রাম শহরে কৃষকের খামারে মজুদ থাকা গবাদি পশুর মধ্যে কোরবানিযোগ্য ষাঁড় রয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ২১১টি, বলদ ১ লাখ ৪০ হাজার ৩১০টি এবং গাভী রয়েছে ৩৭ হাজার ৮০৪টি। মোট গরুর সংখ্যা ৫ লাখ ২৬ হাজার ৩২৫টি। মহিষ রয়েছে ৭১ হাজার ৩৩৩টি। গরু এবং মহিষ মিলে মোট কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৬৫৮টি। এছাড়া ছাগল এবং ভেড়া রয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪০৫টি। যার মধ্যে ছাগল ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৩টি এবং ভেড়া ৫৮ হাজার ৬৬২টি রয়েছে।
তবে এবার চট্টগ্রাম জেলার চাহিদা ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭১৩টি। অর্থাৎ প্রায় এক লাখ পশুর ঘাটতি থাকছে। এছাড়া গতবছর কোরবানির ঈদে গবাদি পশুর চাহিদা ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার। সে বছর বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও খামারে কোরবানিযোগ্য পশু উৎপাদন হয় ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫০১টি। চট্টগ্রাম জেলায় গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ৫০ হাজার পশু কম উৎপাদন হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৭ হাজার ৫৩৩ জন খামারির কাছে গরু-মহিষ মিলে ১৩ লাখ ৪৬০০টি কোরবানিযোগ্য গবাদি পশু রয়েছে। ছাগল এবং ভেড়া রয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮২টি। চট্টগ্রাম বিভাগে মোট পশুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ। মজুদ আছে ১৭ লাখ ৭৩ হাজারের মত। সে হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগে পশুর তেমন ঘাটতি নেই।
প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫০টি খামার রয়েছে। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে গরুর খামার খাতের বেশ বিস্তার ঘটেছে। বাজারে দাম পাওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছে এই ব্যবসার দিকে। বহু শিক্ষিত লোকজনও খামার গড়ে তুলে শত শত গরু মোটাতাজা করছে। গরুর পাশাপাশি অসংখ্য মহিষ ছাগল ভেড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব খামারে বিভিন্ন ব্যাংক কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বিশ থেকে পঞ্চাশ কোটি টাকার গরু মহিষ রয়েছে এমন খামারের সংখ্যাও খুব কম নয়। পরিকল্পিত খামারের বাইরেও চট্টগ্রামের গ্রামেগঞ্জে পারিবারিকভাবে হাজার হাজার গরু ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য খামার। দুই থেকে দশ-বিশটি গরু মহিষ নিয়ে এক একটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে। আবার ঘরের পাশে ছোট্ট একটি ঘর করে দুইটি গরু লালন পালন করছে এমন পরিবারের সংখ্যাও অনেক। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোও পশু পালনে ঋণ প্রদান করেছে। অনেকেই বন্ধু–বান্ধব বা আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পশু পালন করছে। আবার অনেকেই পশু লালন পালনের জন্য টাকা পয়সা বিনিয়োগ করেছে। সবকিছু মিলে চট্টগ্রামে পশু পালন খাত বেশ বিকশিত হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণীস¤পদ বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক ডা. এ কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে পরিকল্পিতভাবে গরু মহিষ ছাগল ও ভেড়া লালন পালন করা হয়েছে। তারপরও যে কিছু পশুর ঘাটতি রয়েছে তার জন্য বিদেশ থেকে পশু আমদানির প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে যেসব পশু আসবে তাতে ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। তবে এবার কোরবানিযোগ্য পশুর দাম বেশি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সবকিছুর দামই তো নাগালের বাইরে। পশুর দাম নাগালে থাকার আশা করে লাভ কি!
চট্টগ্রামের নাহার এগ্রো লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ তানজিব জাওয়াদ রহমান বলেন, কোরবানি উপলক্ষে প্রস্তুতি চূড়ান্ত। খামারে সাড়ে পাঁচশর মতো গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। এবার চট্টগ্রামের প্রতিটি খামারেই গরু মহিষ মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ এবং পশুখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পশুর দাম অনেক বেশি পড়বে। এছাড়া কোরবানির বাজার ধ্বংসে চোরাইপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে একটি চক্র গরু আনতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম জেলা ডেইরী এসোসিয়েশনের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, কোরবানির বিশাল বাজার নিয়ে একটি চক্র সবসময় সক্রিয় থাকে। তারা বিদেশ থেকে পশু আমদানি এবং চোরাইপথে পশু এনে দেশের খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বছর কয়েকের মধ্যে বিকশিত হওয়া বিরাট খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে। চোরাপথে দেশে যাতে কোনো পশু আনা না যায় সেদিকে সতর্ক থাকার জন্যও প্রশাসনের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
আলাপকালে একাধিক খামারি জানান, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় কয়েক বছর ধরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়েই চট্টগ্রামের কোরবানি পশুর চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করা হচ্ছে। তবে এবার গরু-মহিষের দাম বেশি হবে। কারণ গবাদি পশু লালন-পালন অত্যন্ত ব্যয় বহুল হয়ে গেছে। গো-খাদ্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ করে সরকার দেশের খামারিদের সুযোগ করে দিয়েছে। গো-খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে খামারিরা কিছুটা লাভবান হতে পারতো।
অতীতে এককভাবে কোরবানি দিতেন মহিউদ্দিন সেলিম নামে নগরীর শুলকবহর এলাকার এমন একজন কোরবানিদাতা বলেন, তিনি ভাড়া বাসায় থাকলেও মাঝারি আকারের একটি গরু কিনে কোরবানি দিতেন। এবার ভাগে কোরবানি করবেন। অতীতে যেসব মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এককভাবে একটি গরু নিয়ে কোরবানি দিত, তারা এখন ভাগে কোরবানি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ এমনিতেই দিশেহারা। এরপরও অন্য বছরের তুলনায় এবার কোরবানির সংখ্যা কিছুটা বাড়বে।