চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ঘিরে গড়ে উঠেছে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহন বাণিজ্য। এই বাণিজ্য ঘিরে সমূদ্র ও নদ-নদিগুলোতে প্রতিদিন বিচরণ ঘটে অন্তত ১ হাজার ২৫০টি লাইটারেজ জাহাজের। তবে এই সংখ্যা ডব্লিউটিসি কর্তৃক নিবন্ধিত। অনিবন্ধিত লাইটারেজ জাহাজের সংখ্যা এর চেয়ে আরও তিনগুণ বেশি।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রসারের সাথে এই লাইটারেজ জাহাজের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে আরও। যা দিয়ে আয়ের পথ সুগম করছেন মালিকরা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সে আয়ে কোপ পড়েছে তাদের। ডলার সংকটের কারণে দেশে আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে এই লাইটারেজ জাহাজের মালিকদের উপরও।
তাদের ভাষ্য, কোভিড-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বেসামাল বিশ্ব অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়েছে দেশের আমদানি বাণিজ্যের উপর। এতে কমেছে নৌ-পথে পণ্য পরিবহন। ফলে পণ্য পরিবহণ কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ লাইটারেজ জাহাজ এখন কর্মহীন।
চট্টগ্রামে জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী হাজী শফিক আহমেদ বলেন, লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে মাদার ভ্যাসেল থেকে বন্দরে আমদানি পণ্য খালাস করা হয়। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে আমদানি কমায় চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মহীন পড়ে শত শত লাইটারেজ জাহাজ। ফলে লোকসান গুনছেন এসব জাহাজের মালিকরা।
তিনি বলেন, কোভিড পূর্ববর্তি সময়েও মাদার ভ্যাসেল থেকে আমদানি করা পণ্য রাত-দিন খালাস করেও কুল পেত না লাইটারেজ জাহাজগুলো। এ সময় একেকটি লাইটারেজ জাহাজ প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকার পণ্য খালাস করত। কিন্তু সেই পণ্য খালাস এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বন্দর চ্যানেলের নানা ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহনের সাথে জড়িত ১২০০ লাইটারেজ জাহাজ। যার অর্ধেকেরও বেশি এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইমপেক্স লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মাহবুব রানা বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি (ঋণপত্র) কমে গেছে। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, ডলার সংকটে স্ক্র্যপ, সিমেন্ট ক্লিংকার আমদানিও কমেছে। আমদানি কম হওয়ায় বহির্নোঙরে কার্গোবাহী জাহাজের সংখ্যাও কমেছে। ফলে লাইটারেজের চাহিদাও কমেছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, লাইটার জাহাজে বাল্কপণ্য পরিবহন করা হয়। ডলার সংকটের কারণে আমদানি সীমিত হওয়ায় বাল্কপণ্য আমদানি কিছুটা কমেছে। এতে কমেছে লাইটার জাহাজগুলোর চাহিদা। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অধিকাংশ লাইটারেজ জাহাজ।
ডব্লিউটিসির যুগ্ম সচিব (অপারেশন) আতাউল কবীর রঞ্জু বলেন, আমাদের তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫০টি লাইটার জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে এখন ৭০০‘র মতো লাইটারেজ কর্ণফুলী নদীতে অলস সময় পার করছে। কিছু বসা রয়েছে দুই-তিনমাসেরও বেশি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাংয়ের (বিসিভোয়া) কো-কনভেনর নুরুল হক বলেন, আমদানি কিছুটা কমেছে। এটির প্রভাব রয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে, বড় শিল্পগ্রুপগুলো নিজেদের লাইটার দিয়ে পণ্য পরিবহন করছে। এর প্রভাবে আমাদের লাইটারগুলোর বুকিং কম হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ডলার সংকটে আমদানি কমে যাওয়ায় কয়েকমাস ধরে অনেক আমদানিকারক ঋণপত্র খোলা বন্ধ রাখেন। যার প্রভাব পড়েছে দেশের সামগ্রিক আমদানিতে। বিশেষ করে গম, পাথর, ভুট্টা, সিমেন্ট ক্লিংকার, লোহার স্ক্র্যাপ আমদানি অনেকটা সীমিত করেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে চাল-গম আমদানিও। যে কারণে চট্টগ্রামে কার্গো বোঝাই ভ্যাসেল আসা কমে গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, বিগত সময়ে যেখানে শতাধিক মাদার ভ্যাসেল আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে খালাসমান ও খালাসের অপেক্ষায় থাকতো এখন সেটা ৬৫-৭৫টির মতো ভ্যাসেল থাকছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কনটেইনার ভ্যাসেল।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহির্নোঙর ও জেটিতে অবস্থানকারী জাহাজের ওভারসাইট থেকে কেবল লাইটারেজ জাহাজেই পণ্য খালাস করা হয়। বহির্নোঙর থেকে পাথর, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ, গম, কয়লা, সার, ভুট্টা, ডাল, চিনি, লবণ, সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। ফলে সারাবছর লাইটারেজ জাহাজের চাহিদা থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১৩ জুন পর্যন্ত বাল্ক পণ্যবাহী ৪৩টি জাহাজ বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে পণ্য খালাস হচ্ছে ৩২টি থেকে। খালাসরত জাহাজগুলোর মধ্যে পাঁচটি জেনারেল কার্গো, ছয়টি ফুড গ্রেন, দুটি সার, ১৫টি সিমেন্ট ক্লিংকার, দুটি চিনি এবং দুটি অয়েল ট্যাংকার রয়েছে।
জানা যায়, দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজারের মতো লাইটার জাহাজ রয়েছে। বেশ কয়েকবছর ধরে বহির্নোঙর থেকে লাইটারেজ পণ্য খালাস নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)।
ডব্লিউটিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে প্রায় সাড়ে ১২০০ লাইটারেজ রয়েছে। ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ৭০০ লাইটারেজ খালি অবস্থায় পণ্য বোঝাইয়ের বুকিং সিরিয়ালে ছিল। অন্যদিকে ডব্লিউটিসির বাইরে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের শত শত লাইটারেজ রয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব লাইটারেজগুলো নিজেদের আমদানি পণ্য পরিবহন করলেও ছোট ছোট মালিকদের জাহাজগুলো সংকটে পড়েছে।