সোমবার- ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪

প্রচ্ছদ /

চট্টগ্রামে সিনেমা হলের একাল-সেকাল

print news

সিনেমা ও সিনেমা হলের একাল-সেকাল নিয়ে বলতে গেলে আগে চলে আসে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কথা। কারণ একসময় সিনেমার দর্শকপ্রিয়তায় অন্যতম কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। বন্দর শহরে নানা দেশের মানুষের আনাগোনা ছিলও সবচেয়ে বেশি। এ কারণে চট্টগ্রামে ২৮টি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে পুরণো এসব সিনেমা হলের মধ্যে আছে এখন মাত্র দুইটি।

অবশ্যই নতুন দুটি সিনেমাপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে নগরীর চকবাজার এলাকায় (নবাব সিরাজ উদ্দিন রোড) বালি আর্কেড শপিং কমপ্লেক্সে স্টার সিনেপ্লেক্স চালু হয় গত ২ ডিসেম্বর। এই মাল্টিপ্লেক্সে মোট ৩টি হল রয়েছে।

স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান বলেন, করোনা মহামারিতে অন্যদের মতো আমরাও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে ‘পরান’ ও ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটি চালিয়ে সিনেপ্লেক্সে আমাদের ব্যবসা ফিরেছে।

ভালো সিনেমা নির্মিত হলে মানুষ সিনেমা হলে এসে অবশ্যই সিনেমা দেখবে। সেই কারণে চট্টগ্রামে সিনেপ্লেক্সে করার সাহস দেখিয়েছি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আমাদের দেশের যে সিনেমাগুলো মুক্তি পাচ্ছে সেই সিনেমাগুলো দু’এক মাস যদি প্রথমে সিনেমা হলে মুক্তি পায়, তাহলে আমার বিশ্বাস এই সিনেমাগুলো ভালো ব্যবসা করবে। অন্যথায় আগের পূরণো সিনেমা হলগুলোর ভাগ্য বরণ করতে হবে আমাদেরও-বলেন তিনি।

সূত্রমতে, চট্টগ্রামে একসময়ে জনপ্রিয় সিনেমা হলগুলোর মধ্যে ছিল বনানী কমপ্লেক্স, অলংকার, রিদম, গুলজার, দিনার, আলমাস, নেভি সিনেমা, লায়ন, উজালা, খুরশিদ মহল, সাগরিকা, নুপুর, ঝুমুর, সানাই, পূরবী, জলসা, উপহার, আকাশ, মেলোডি, সঙ্গীত, রঙ্গম, কর্ণফুলী, নূরজাহান, চাঁদনী, রূপালী, উজালা, শাহীন ইত্যাদি। যেখানে সারাবছর তো দর্শক মেতে থাকতই। প্রতিবছর ঈদে মেতে উঠত অন্যভাবে। এখন সেদিন আর নেই। চট্টগ্রামে সিনেমা ও সিনেমা হলের বিষয়টি এখন একাল-সেকালের মতো হয়ে গেছে।

সিনেমা হলের সেকাল ও একাল নিয়ে কথা হয় হল মালিক ও সিনেমা প্রযোজক মো. আবুল হোসেনের সঙ্গে। প্রায় ৪৫ বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। চট্টগ্রামের অন্যতম সিনেমা হল প্যালেসকে তিনি ১৯২৮ সালে থিয়েটার হল থেকে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তর করেন। হলটি এখনো টিকে আছে কালের পরিক্রমায়। একইভাবে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামের কাজির দেউরী এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ঝুমুর সিনেমা হল। হলটি ২০১৫ সালে লোকসানের কারণে বন্ধ করে দেন আবুল হোসেন। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে এটি চালু করেন সুগন্ধা নাম দিয়ে।

সিনেমা হলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবুল হোসেন বলেন, ঈদে নতুন জামা-কাপড় কেনাকাটার মতোই সিনেমা হল নিয়ে বিশেষ নজর থাকত দর্শক কিংবা হল মালিকদের। দর্শকদের আগের চেয়ে ভালো সেবা বা সুবিধা দেয়ার জন্য বিভিন্ন আয়োজন রাখার চেষ্টা থাকত। ঈদে বাঙালির নানা বিনোদনের মধ্যে সিনেমা দেখা ছিল অনেকটা অত্যাবশ্যকীয়। বন্ধুবান্ধব ছাড়াও পরিবার নিয়ে মানুষ সিনেমা দেখতে আসত। সিনেমা দেখা দর্শকদের মধ্যে সব শ্রেণীর মানুষই ছিল। ঈদের সময়ে একের পর এক সিনেমা হল ঘুরে ঘুরে শহরের সবগুলো হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখার দর্শকেরও অভাব ছিল না।

ঈদকে ঘিরে হলের জমজমাট অবস্থা নিয়ে তিনি আরো বলেন, ঈদ আসলে বর্তমানে যেমন বাড়িতে যাওয়ার যানবাহনের টিকিট নিয়ে হাহাকার হয়, সিনেমা হলের টিকিট নিয়েও সেভাবে আলোচনা, কাড়াকাড়ি ছিল। সিনেমার টিকিট কালোবাজারি হতো, পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি হতো। অনেক উচ্চ পর্যায় থেকে টিকিটের জন্য লবিং হতো, সিনেমা হলের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হতো, শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা সুষ্ঠু রাখার জন্য। ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি বিনিয়োগ, ঈদের আগে মালিকরা ঢাকায় গিয়ে কে ভালো সিনেমার বুকিং দিতে পারবে সে প্রতিযোগিতা চলত। ঈদের আগে হলে বাড়তি লোকবল নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি জেনারেটরসহ সব আয়োজন সুনিপুণ করে রাখা হলেও ঈদের দিন বিকালেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেত দর্শকের চাপে। এ ব্যর্থতাও ছিল আনন্দের। সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পেলে লাভের মুখ দেখার পাশাপাশি হলজুড়ে মানুষের পদচারণা দেখে অন্য রকম অনুভূতি হতো।

সিনেমা হলের টিকে থাকার লড়াই প্রসঙ্গে মো. আবুল হোসেন বলেন, ২০০০ সালের পর একে একে বন্ধ হতে থাকে চট্টগ্রামের সিনেমাহলগুলো। সিনেমা হল ভেঙে গড়ে ওঠে বহুতল মার্কেট। বর্তমানে বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামে এখন সিনেমা হলের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র ৪টি। এই হলগুলোর তালিকায় রয়েছে সিলভার স্ক্রিন, সিনেমা প্যালেস, সুগন্ধা সিনেমা ও স্টার সিনেপ্লেক্স। এর মধ্যে গত ২ ডিসেম্বর স্টার সিনেপ্লেক্স চালু হয়েছে। শহরের চকবাজার এলাকায় (নবাব সিরাজ উদ্দিন রোড) বালি আর্কেড শপিং কমপ্লেক্সে মাল্টিপ্লেক্স এই সিনেমা হল অবস্থিত। এই মাল্টিপেপ্লক্সে মোট ৩টি হল রয়েছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে দুই বছর আগেও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির অধীনে আলমাস সিনেমা হল চালু ছিল। এরই মধ্যে দর্শক শূন্যতায় সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্যালেস ও সুগন্ধা নামের সিনেমা হল কোনো রকমে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে যাচ্ছে। ভালোমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে দর্শকরা এখনো হলে গিয়ে সিনেমা দেখে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণে দর্শকের রুচির কথা মাথায় রেখে মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ করতে হবে। তাহলে দর্শক আবারো হলে ফিরবে।

চট্টগ্রামে এক কালের সিনেমা হলের দর্শক প্রীতম দাশ বলেন, সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ ভালো হলে মানুষ অবশ্যই সিনেমা দেখতে যাবে। যে হলগুলোর পরিবেশ ভালো না চেয়ার ফ্যান, এসি নাই, সেইসব হলে মানুষ কেন সিনেমা দেখতে যাবে? এখন কিছু সিনেমাহল হচ্ছে সেগুলো মানসম্মত। ভালোমানের সিনেমাহলের পাশাপাশি যদি ভালো গল্প, নায়ক, নায়িকাদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা হয় অবশ্যই মানুষ সিনেমা দেখবে। তার প্রমাণ আমরা দেখেছি ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘দেবী’, ‘মেইড ইন চিটাগং’ সিনেমাগুলোর মাধ্যমে। ভালো সিনেমা হলে মানুষ হলে আসে।

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page