গত কয়েক বছরের মতো চট্টগ্রামে এবারও কোরবানির চামড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। সর্বনিম্ন ৫০ টাকায়ও আস্ত একটা গরুর চামড়া কিনে নিয়েছে চামড়া সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তবে গুটি কয়েক অসহায় কোরবানির দাতার কাছ থেকে এই দাম চামড়া ছিনিয়ে নিলেও সবখানে তেমন সুবিধে করতে পারেনি। এরপরও ৩০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনেনি সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
এই অবস্থা দেখে নগরীর অধিকাংশ কোরবানিদাতা বিনামুল্যে চামড়া তুলে দিয়েছে গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের হাতে। আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের এই অঙ্গ সংগঠনটি করোনা সংক্রমণ ও সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে হতাহতদের উদ্ধার, সিলেটে বন্যার্তদের সেবায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। কুড়িয়েছে চট্টগ্রামবাসীর ভালোবাসা।
যার প্রতিদান হিসেবে গত বছরের মতো এবারও পেলো কোরবানির পশুর চামড়া। এর আগে কম মুল্যে চামড়া বিক্রী না করে নগরীর কোরবানিদাতাদের অনেকে পশুর চামড়া মাটিতে পুতে ফেলে বা রাস্তা সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তখন চামড়া নিয়ে টানাটানি করতে হয় চসিককে।
চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদার সমিতির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, বিগত বছরগুলোতে চট্টগ্রামের অন্তত কয়েকটি প্রভাবশালী চামড়া সিন্ডিকেট কোরবানি দাতাদের জিম্মী করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দামে চামড়া কিনে অধিক মূল্যে চামড়া বিক্রয় করতো আড়তে। আড়তদাররা তাদের মুল্যে চামড়া না কিনলে তা রাস্তায় ফেলে রাখা হতো।
তিনি বলেন, ২০২০-২১ সালে এমন পরিস্থিতি তৈরী হওয়ায় আড়তদাররা এই সংঘবদ্ধ চক্র থেকে চামড়া কিনেনি। ফলে পরবর্তিতে তারা হাজার হাজার চামড়া রাস্তায় ফেলে চলে যায়। এমনকি চসিকের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। যা পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয়েছে চসিককে। এবার সেই চক্র ধরাশায়ী হয়েছে গাউছিয়া কমিটির কাছে।
তিনি বলেন, এবার গাউছিয়া কমিটি বিভিন্ন মাদরাসার মাধ্যমে অনেক চামড়া সংগ্রহ করেছে। সেজন্য আড়তেও চামড়া কম আসছে। গাউছিয়া কমিটির কারণে এবার ফড়িয়ারা সুবিধা করতে পারেনি। বাজারে বিশৃঙ্খলা নেই। সরকার যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার চেয়ে কম দামে আমরা চামড়া কিনতে পারছি। আমরা ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে গরুর চামড়া কিনতে পারছি।
জানা যায়, গাউছিয়া কমিটি প্রায় সাত হাজার কর্মী মাঠে নামে, যাদের অধিকাংশই মাদরাসার ছাত্র। নগরীতে তাদের সাংগঠনিক ১৩টি থানা, ৪৭টি ওয়ার্ড এবং ৭০০ ইউনিট কমিটি আছে। প্রতিটি সাংগঠনিক ইউনিটে এক বা একাধিক চামড়া সংগ্রহের বুথ স্থাপন করা হয়। ৭০টি ভাড়ার ট্রাক এবং ৩০টি নিজস্ব ছোট-বড় ট্রাকের মাধ্যমে নগরীর অলিগলি ও বাসাবাড়িতে গিয়ে কর্মীরা সংগ্রহ করেন কোরবানির পশুর চামড়া।
সংগ্রহ করা চামড়া জমা করে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে নগরীর বিবিরহাট এলাকায় জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার বিশাল মাঠে। সেখানে নগরীর ১৪ থানা এলাকা থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া রাখা হচ্ছে। বাকি দুই থানা পতেঙ্গা ও হালিশহর থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া রাখা হচ্ছে হালিশহরে একটি সুন্নিয়া মাদরাসার মাঠে। সেখানেও আলাদাভাবে লবণ দিয়ে চামড়াগুলো প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।
শনিবার (১ জুলাই) বিবিরহাটে সুন্নিয়া মাদরাসার মাঠে গিয়ে দেখা গেল বিশাল কর্মযজ্ঞ। ট্রাকে ট্রাকে ঢুকছে কাঁচা চামড়া। সামিয়ানা ও ত্রিপল টানিয়ে পুরো মাঠ ঢেকে ফেলা হয়েছে। সেখানে আলাদা-আলাদা জোন করা হয়েছে প্রত্যেক থানার জন্য। গাউছিয়া কমিটির কর্মকর্তারা পুরো কর্মযজ্ঞ সুশৃঙ্খলভাবে স¤পন্ন করার কাজ তত্ত্বাবধান করছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর গাউছিয়া কমিটির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, কোরবানির দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিবিরহাটে মাদরাসার মাঠে এসেছে সংগ্রহ করা প্রায় ৫০ হাজার কাঁচা চামড়া। হালিশহর মাদরাসায় জমা হয়েছে আট থেকে দশ হাজার চামড়া। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম নগরী থেকে প্রায় ৬০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের পরিচালনাধীন মাদরাসাগুলোতে চামড়া সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তারা প্রায় এক লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন।
প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ বলেন, আমরা প্রতিবছরই চামড়া সংগ্রহ করি। গতবছরও আমরা এক লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করেছি। এবার আমরা সুসংগঠিতভাবে করছি। এছাড়া করোনায় মৃতদের লাশ দাফন, বিএম ডিপোতে অগ্নিকান্ডে নিহতদের লাশ উদ্ধার, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের আমরা যেভাবে সহায়তা করেছি, তাতে মানুষ আমাদের ওপর খুশি। সেজন্য আমরা এবার মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছি। তারা খুশি হয়ে তাদের কোরবানি দেওয়া পশুর চামড়া আমাদের দিয়েছেন। আমরা যত চামড়া সংগ্রহ করেছি সব বিনামূল্যে, এক টাকাও আমাদের খরচ হয়নি। ইনশাল্লাহ, আমাদের এ কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে কোরবানির কাঁচা চামড়ার বাজার প্রতিবছর নিয়ন্ত্রণ হতো সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে। কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করতেন এলাকার উঠতি তরুণ-যুবকরা, যাদের মৌসুমি সংগ্রহকারী বলা হয়। তারা কয়েকজন মিলে ৫-৬টি করে চামড়া সংগ্রহ করতেন। তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে নিতেন বড়-মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা, যারা শুধু কোরবানির সময়ই চামড়া কিনতে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন এবং সেই চামড়া বিক্রি করেন আড়তদারের কাছে। সেই ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া বিক্রি করতেন আড়তদারের প্রতিনিধির কাছে। প্রতিনিধির কাছ থেকে চামড়া যেত আড়তদারের ডিপোতে।
চট্টগ্রামে ছোট-বড় ২২৫টি আড়তে চামড়া সংরক্ষণ হয়। আড়তদার আছেন ৩৭ জন। অধিকাংশ আড়ত নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায়। কোরবানির দিন চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর থেকে আসা কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বেশি সমাহার ঘটে এই আতুরার ডিপো এলাকায়। ডিপোর বাইরে সড়কে লাখো চামড়ার হাতবদল হয়। হাজার-হাজার ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটে। কিন্তু এবার আতুরার ডিপোর পরিস্থিতিও ভিন্ন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি এবার গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছিল।
কোরবানি আর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যে বিস্তর ফারাক :
চট্টগ্রামে এবার কোরবানি দেওয়া হয়েছে ৮ লাখ ৭৪ হাজার পশু। আর ব্যবসায়ীদের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য সাড়ে তিন লাখ। চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিস¤পদ বিভাগের দেওয়া কোরবানির এ তথ্যের সঙ্গে চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাপক ফারাক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিস¤পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বলেন, চামড়া সংগ্রহ বা সংরক্ষণের বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়ের, প্রাণিস¤পদ বিভাগের নয়। তবে এবার কোরবানিতে চট্টগ্রামে ৮ লাখ ৭৪ হাজার পশুর চাহিদা ছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রামে উৎপাদন হয়েছে আট লাখ ৪২ হাজার পশু। কোরবানি উপলক্ষে অবশিষ্ট পশু দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে চট্টগ্রামের বাজারে আসে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত ২০২২ সালে চট্টগ্রামে কোরবানির চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল তিন লাখ ৪৩ হাজার ২৫০টি। এর মধ্যে গরুর চামড়া ছিল তিন লাখ ১৬ হাজার ৪৫০। ছাগলের চামড়া ছিল ২৬ হাজার ৮০০ পিস। গত ২৫ জুন সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় চামড়ার দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
ঘোষণা অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। গত বছর ঢাকায় এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ৪০ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। এছাড়া সারাদেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতোই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকবছর ধরে কাঁচা চামড়া নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। পাঁচ-সাত বছর আগেও কোরবানির যে চামড়া হাজার টাকার ওপরে বেচা যেত এখন সেই চামড়া দুই থেকে তিনশ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাঁচা বড় চামড়া চারশ টাকার বেশিতে কেনেন না আড়তদাররা। ছোট ও মাঝারি চামড়া কেনেন দুইশ থেকে তিনশ টাকায়। এতে গড়ে তিনশ টাকার বেশিতে চামড়া কিনতে হয় না আড়তদারদের। তবে এবার লবণের দাম বেশি হওয়ায় প্রভাব পড়বে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ স¤পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলতি বছর চট্টগ্রামে সাড়ে তিন লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এবার লবণের দাম বেশি হওয়ায় চামড়া সংগ্রহে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি বলেন, ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি চামড়া সংগ্রহ করতে এক বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতিবস্তা লবণের মূল্য ১২৫০ টাকা। চট্টগ্রামে একেকটি গরুর চামড়া ২০-২২ ফুট পর্যন্ত হিসাব করা হয়। তবে ট্যানারি মালিকরা চামড়া সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে ২০ ফুটের বেশি হিসাব করেন না।
চামড়া পাচারের শঙ্কা :
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা বলেন, চামড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানিজাত পণ্য। কিন্তু দেশে কাঁচা চামড়ার মূল্য নেই। বিগত বছরগুলোতে বিক্রি করতে না পেরে অনেকে কাঁচা চামড়া ফেলে দিয়েছেন। এখনো কাঁচা চামড়ার দাম বাড়েনি।
তিনি বলেন, কোরবানিতে চামড়া সংগ্রহ নিয়ে প্রশাসনের কাছে কোনো সঠিক তথ্য নেই। প্রাণিস¤পদ বিভাগ বলছে চট্টগ্রামে পৌনে ৯ লাখ পশু কোরবানি হবে। আবার চট্টগ্রামে চামড়া আড়তদাররা বলছেন সাড়ে তিন লাখের মতো কাঁচা চামড়া তারা সংগ্রহ করবেন। অবশিষ্ট সোয়া পাঁচ লাখ চামড়ার হিসাব কারও কাছে নেই। উপজেলা পর্যায়ে তো এত সংখ্যক চামড়া সংরক্ষণ হওয়ার কথা নয়। দেশের বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চামড়ার দাম বেশি। দেশে কাঁচা চামড়ার দাম কম হওয়ায় পাচারের আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করা।
চট্টগ্রামে চামড়া সংগ্রহের সঠিক তথ্য আছে কি না জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছে সঠিক পরিসংখ্যা নেই। বিষয়টি আমাদের নজরেও ছিল না। এখন পুরো জেলায় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে।
চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সঠিকভাবে বলা সম্ভব না। তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে আমরা নজরদারি বাড়াবো।