বিদায়ের পথে শ্রাবণ মাস। এই সময়ে টানা বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। অথচ এর আগে তেমন বৃষ্টিপাত ছিল না। আবহাওয়া অফিস বলছে, নিম্নচাপের প্রভাবে ঝড়ছে বৃষ্টি। রয়েছে ৩নং সতর্ক সংকেতও। তার সাথে যোগ হয়েছে পূর্ণিমার ভরা জোয়ার। এই বৃষ্টি আর জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর এক তৃতীয়াংশ এলাকা।
আর এতে দুর্ভোগের শেষ নেই চট্টগ্রাম নগরবাসীর। এই অবস্থা ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুরু। যা বিরাজ করছে ৫ আগস্ট শনিবারও। চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কে বি আমান আলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়া, ফরিদার পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, মুন্সীপুকুর পাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, তিন পুলের মাথা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, মুরাদপুর এবং হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে ও অলিগলি এখন থই থই করছে পানিতে।
অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামে গত কয়েকবছর ধরে চার স্তরে বাস্তবায়ন চলছে মেগা প্রকল্প। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার মতে, তাদের প্রকল্পের প্রায় ৭৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এরপরও এক রাতের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ডুবে গেছে নগরীর এক তৃতীয়াংশ এলাকা।
তবে এই জলাবদ্ধতা তৈরির জন্য যতটুকু না বৃষ্টিপাতকে দায়ি করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দায়ি করা হচ্ছে প্রবল জোয়ারকে। বলা হচ্ছে-কর্ণফুলী নদিতে এখন প্রবল জোয়ার। জোয়ারের পানিতে উপচে পড়ছে মহানগরীর সবকটি খাল। ফলে বৃষ্টির পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এতে নগরজুড়ে থই থই করছে পানি। অর্থাৎ জোয়ারে মলিন হয়ে গেছে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প।
এমন দাবি খোদ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চউকের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদিতে গত তিন বছর ধরে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদিকে শহরের অনেকগুলো খালের মুখে স্লুইচ গেইট নির্মাণ করা হলেও তা এখনো চালু হয়নি। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকে যায় শহরে। একইসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় খালে আশপাশের এলাকার পানি যেতে পারেনি।
একই মতামত জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলীর। তিনি বলেন, বৃষ্টির সময় উচ্চ জোয়ার থাকায় প্রভাব পড়েছে। জোয়ারের লেবেল বেশি ছিল। অন্যান্য সময়ের তুলনায় লো টাইড (নিম্ন জোয়ার) থেকে হাই টাইডে (উচ্চ জেয়ার) পানি বেড়েছে ১৪ ফুট। অন্য সময়ে জোয়ারের উচ্চতা ৪ দশমিক ১ বা ৪ দশমিক ২ মিটার থাকলেও এখন ৫ দশমিক ৬ মিটার। ফলে জোয়ারের পানিতে খাল পুরোটা ভরাট ছিল। যেহেতু জোয়ারের পানিতে খাল ভরে গেছে তখন এলাকার বৃষ্টির পানি আর খালে যেতে পারেনি। তবে এ সমস্যা সবখানে হয়নি। যেসব খালে রেগুলেটর (স্লুইচ গেইট) ফাংশনাল হয়নি সেখানে জোয়ারের পানি ঢুকেছে।
তিনি বলেন, হালিশহর-আগ্রাবাদ এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকেনি। কারণ ওসব এলাকার জন্য নির্ভরশীল মহেশখালে আমাদের যে রেগুলেটর সেটা চালু হয়ে গেছে। ফলে অন্যান্য এলাকার তুলনায় হালিশহর-আগ্রাবাদ এলাকায় ভোগান্তি কম হয়েছে। চউকের অন্য প্রকল্পে যে রেগুলেটর রয়েছে সেগুলোর কাজ যদি স¤পূর্ণ হয়ে যেত তাহলে এ অবস্থা হতো না।
তিনি আরও বলেন, রেগুলেটার ফাংশনাল না হওয়ায় চাক্তাই খাল, চাক্তাই ডাইভার্শন খাল ও রাজখালী খাল সংলগ্ন যেসব এলাকা তার পুরোটাই জোয়ারের পানির প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচলাইশ, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, শোলকবহর, বহাদ্দারহাটসহ আশেপাশের এলাকা উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকায় জোয়ারের কারণেই খালে পানি যেতে পারেনি।
সচেতন মহলের প্রশ্ন, জোয়ারের কারনে খালে যদি বৃষ্টির পানি নামতে না পারে, তাহলে খাল খনন করে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নমে হাজার কোটি টাকা খরচের হেতু কি? বরং খাল খনন করে জোয়ারের পানিকে নগরী ডুবিয়ে দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তার চেয়ে নগরীর প্রতিটি খালের মুখে জোয়ারের পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণে করলেই হতো। তাতে হাজার কোটি টাকা বেচে যেত। এখন এত টাকা খরচ করে জলাবদ্ধতা নিরসন হলো কোথায়? তাহলে এ প্রকল্প গ্রহণে নীতি-নির্ধারকদের কি কোনোরকম ত্রুটি ছিল?
এমন শত শত প্রশ্ন রেখেছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান। তিনি বলেন, পরিবেশবিদরা কয়েকদশক ধরে সতর্কবাণি দিচ্ছেন সাগর পৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে জোয়ারের উচ্চতাও। বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামকে কীভাবে জলাবদ্ধতার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা যায়, সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে চট্টগ্রাম মহানগরীর খাল খনন, সড়ক ভরাট করে উচ্চতা বৃদ্ধির মতো যে কাজগুলো করে যাচ্ছে তা মোটেও যুথসই বলে মনে হচ্ছে না। এসব কাজের কারণে ইতোমধ্যে নগরীর পুরো এলাকায় গড়ে উঠা ভবনের নিচ তলা মাটির নিচে হারিয়ে গেছে। এতে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরীর মানুষ। অন্যদিকে জলাবদ্ধতা বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসী প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ফলে এই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর চারপাশ জুড়ে ৫৭টি ছোট-বড় খাল রয়েছে। তম্মধ্যে ৩৬টি খাল জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সংস্কার কাজ করছে চউক। বাকি খালগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ সার্বিক তদারকি করে চসিক।
সংস্থা দুটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এক সময় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্য খালগুলোর যথাযথ তদারকি না করার অভিযোগ করত একে অপরের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রায়ই বাকবিতন্ডায় জড়াতেন কর্মকর্তারা। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ৩৬ খাল খনন কাজ করে প্রতিটি খালের মুখে রেগুলেটর বসালেও দেখা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনের তেমন উন্নতি হয়নি। এক্ষেত্রে চউক বৃষ্টির চেয়েও প্রবল জোয়ারকে দায়ি করলেও চসিক বরাবরের মতোই চউককে দায়ি করছেন।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কমকর্তা আবুল হাশেম তালুকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, চউকের নিয়ন্ত্রাধীন খালগুলোর মধ্যে চাক্তাই খাল হচ্ছে শহরের মেইন খাল। এই খালের মাটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। বর্ষার আগে মাটি নিয়ে যাবার জন্য আমরা বারবার বলেছি। এভাবে আরও কয়েকটি খাল থেকে মাটি সরাতে বলেছি। কিন্তু চউক সেটা না করায় শহর আবার পানিতে ডুবেছে। অথচ এবার জলাবদ্ধতা কম হবে বলে আমাদের ধারণা ছিল।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প নামে এই প্রকল্প ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে দু‘দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চউক। ২০১৭ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি কম। চট্টগ্রাম নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও। বহদ্দারহাট বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প গ্রহণ করেছে তারা। বরাদ্দ ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। পরে সময় বাড়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
এদিকে নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন শীর্ষক এ প্রকল্পের অধীন কর্ণফুলীতে যুক্ত ২৩টি, হালদায় যুক্ত তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে যুক্ত ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পা¤প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। এতদিনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া কথা থাকলেও তা হয়নি।