খাল, নালা-নর্দমা, বাসা ও সড়কে চারিদিকে থই থই করছে পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুক ছুঁই ছুঁই পানি। কোথাও ঢেউ খেলছে, আবার কোথাও বইছে স্রোত। দৃশ্যত যেন এক বহমান নদী। এমন পরিস্থিতি এখন চট্টগ্রাম শহরের।
যার ওপর দিয়ে চলছে রিক্সা, অটোরিক্সা, বাস-মিনিবাসসহ নানা যানবাহন। চলছে নৌকাও। সাতরিয়ে চলছে কর্মজীবি মানুষও। এছাড়া ভাসছে ঘর-বাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ ও ছোট-বড় বহুতল ভবন। সবমিলিয়ে নিদারুন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষ।
রোববার (৬ আগস্ট) সকাল থেকে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণ নগরীর খুলশি ও অক্সিজেনের পাহাড়ি এলাকা ছাড়া ৪১ ওয়ার্ডের সবকয়টি এলাকায় এখন থই থই করছে পানি। এর মধ্যে শনিবার বিকেল থেকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজার পরিণত স্রোতস্বীনি পদ্মা নদীতে। আর চকবাজার পরিণত হয় কক্সবাজারে।
এসব এলাকার দোকানপাট ও বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে নষ্ট হচ্ছে আসবাবপত্র। জ্বলছে না রান্নার চুলা। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিল্পকারখানা খোলা থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চাকরিজীবীরা। বাড়তি ভাড়া দাবি করছে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা। উন্মুক্ত নালা ও ফুটপাতের ভাঙা স্ল্যাব পথচারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে অনেকটা।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ উজ্জল কান্তি পাল জানান, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রামে ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে বৃষ্টিপাতে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। আগামি মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারী বর্ষণ হতে পারে। এরপর বৃষ্টিপাত একটু কমে আসতে পারে। এই সময়ে চট্টগ্রামসহ সবকটি সমূদ্র বন্দরে ৩নং সতর্ক সংকেত জারি রয়েছে। রয়েছে পাহাড় ধসের সতর্কতাও।
তিনি জানান, চার দিনের বৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা মোহরা, হামিদচর, চর রাঙামাটিয়া, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, বাস টার্মিনাল, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, খাজা রোড, মিয়াখাননগর, প্রবর্তক মোড়, মেহেদীবাগ, ষোলশহর ২ নং গেট, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ছোটপুল-বড়পুল, গোসাইলডাঙ্গা, বৃহত্তর হালিশহর, হালিশহরের অনেক এলাকা এখন পানির নিচে।
খলিফাপট্টি থেকে শুরু করে শহরের মধ্যে উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত নন্দনকাননের সড়কেও পানি জমেছে। এসব এলাকার প্রধান সড়কের কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুক ছুঁই ছুঁই পানিতে তলিয়ে যায়। এসব এলাকার শত শত মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
রিয়াজ উদ্দিন বাজার যখন স্রোতস্বীনি পদ্মা :
চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজার। এ বাজারে রয়েছে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি দোকানপাট। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বর্ষণে হাটু পানিতে তলিয়ে যায় এই বাজার। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য এক রকম বন্ধ হয়ে পড়ে। সেই সাথে দোকানপাটে পানি ঢুকে প্রচুর মালামাল নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যবসায়ীরা।
এ তথ্য জানান রিয়াজ উদ্দিন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনিস হায়দার। তিনি বলেন, প্রতিবছর বর্ষায় রিয়াজ উদ্দিন বাজারের অলিগলির সড়ক পানিতে ডুবলেও দোকানপাটে তেমন ঢুকেনি। কিন্তু এবার বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানি যোগ হওয়ায় দোকান পাটে পানি প্রবেশ করে। এতে হাজার-হাজার দোকানের মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, গত শুক্রবার পর্যন্ত যেমন-তেমন, শনিবার বিকেলে প্রবল জোয়ারের সাথে ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে নিউমার্কেটের জুবিলী রোড ডুবে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের দিকে ভয়াবহ স্রোত সৃষ্টি হয়। এতে সড়ক পার্শ্বস্থ শত শত দোকানের মালামাল স্রোতের টানে চলে যায়। এ স্রোত দেখতে পদ্মার স্রোতের মতো। যা বিগত সময়ে আমরা কোনদিন দেখিনি।
রিয়াজ উদ্দিন বাজার আমতলের কাপড়ের দোকানদার মো. সেলিম হোসেন বলেন, শনিবার বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ প্রবল স্রোত শুরু হয় রিয়াজ উদ্দিন বাজারের সড়কে। এ সময় আমার দোকানের অনেকগুলো কাপড়ের গাইড ভেসে যায়। এতে আমার কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সড়কের শত শত দোকান ডুবে গিয়ে মালামাল নষ্ট ও স্রোতের টানে ভেসে গেছে বলে জানান তিনি।
চকবাজার যখন কক্সবাজার :
চট্টগ্রামের নিচু এলাকাগুলোর মধ্যে চকবাজার একটি। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় সবার আগে ডুবে এই চকবাজার। তবে গত ৪-৫ বছর ধরে চকবাজারের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। চলতি টানা বর্ষণেও গত তিন দিন ধরে এই চকবাজারে ঢেউ খেলছে পানি। যাকে কক্সবাজারের সাথে তুলনা করছে সেখানকার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বসিন্দারা।
গত শনিবার বিকেলে চকবাজারে বুক ছুঁই ছুঁই পানি থই থই করার পর সেখানকার ব্যবসায়ীরা নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন-চকবাজার এখন কক্সবাজার। কারো যদি পানির সাথে খেলতে ইচ্ছে করে চলে আসুন চকবাজার। এমন এক পোস্ট দিয়েছেন চকবাজার চকভিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল আলম। আর এতে ব্যাপক সমালোচনা করে কমেন্টস দেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
যেখানে এই জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির স্বঘোষিত সভাপতি সোলায়মান শেঠকে দায়ি করে ব্যাপক ক্ষোভ ঝারেন স্থানীয়রা। আবুল বাশার নামে এক বসিন্দা এই পোস্টের কমেন্টসে লিখেন- সোলায়মান শেঠ চকবাজারের মধ্য দিয়ে বহমান খাল দখল করে অভিজাত বহুতল মার্কেট ‘বালি আর্কেড’ নির্মাণের পর থেকে চকবাজার প্রতি বছর বর্ষায় হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার। এই দখলবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা যেন চট্টগ্রাম শহরের কারো নেই।
হাবিব রেজা নামে একজন লিখেন-এই ভুমিদস্যুর কারণে চকবাজারের দুই হাজারের বেশি দোকান বুক ছোঁয়া পানিতে ডুবে গেছে। এই চকবাজারের সড়ক ও বাসাবাড়িতে এখন পানি থই থই করছে। গত তিন ধরে অনেক বাসাবাড়িতে রান্না-বান্না পর্যন্ত হচ্ছে না।
অন্য এলাকার চিত্র :
চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের মোহরা এলাকার বাসিন্দা রিপন তালুকদার জানান, মোহরা আনার উল্লাহ শাহজী রোডে হাঁটুপানি জমে রয়েছে। এছাড়াও নাজিরবাড়ি, পুরান চান্দগাঁও, কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা, বিসিক শিল্প এলাকা, চর রাঙামাটিয়া, হামিদচর আবাসিক এলাকা, টেকবাজার, বরিশাল, সিএন্ডবি এলাকাসহ আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। শত শত ঘরে পানি ঢোকায় রান্নাবান্না হয়নি।
হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল, গৃহবধূ ফারজানা বেগম জানান, বেশির ভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকে গেছে। এতে রান্নাবান্নাসহ বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। শত শত লোকজন গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। ফারজানা বেগম বলেন, শত শত শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ভাড়া গুণে স্কুলে যেতে হচ্ছে। ২০ টাকার রিকশা ভাড়া একশ টাকায় যেতে হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটু ও কোমর পানি মাড়িয়ে বাসায় ফিরতে মেয়েদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, বৃষ্টির কারণে বলিরহাট, জেলেপাড়া, শীলপাড়া, বজ্রঘোনা, চেয়ারম্যান ঘাটা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকে রান্নাবান্না পর্যন্ত হচ্ছে না। আক্ষেপ করে ওয়ার্ড কান্সিলর এসরারুল হক বলেন, আমরা তো গলা পর্যন্ত ডুবছি! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি মাথাসহ ডুবে যাবে?
এদিকে বিভিন্ন সড়কে পানি ওঠায় সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল করছে। কোনো কোনো সড়কে যানবাহনে পানি ঢুকে ও গর্তে পড়ে বিকল হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানান চালকেরা। গুটিকয়েক স্থানে যানবাহন বদল করে চলাচল করলেও দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হচ্ছে। রাস্তায় যানবাহনের অভাবে শত শত লোক পানিতে সাতরিয়ে হাবুডুবু খেয়ে হেঁটে গন্তব্যে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
অক্সিজেন টেক্সটাইল এলাকার বাসিন্দা এহসান উল্লাহ জাহেদী জানান, সকালে বের হয়ে খাতুনগঞ্জ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় ষোলশহর ২নং গেট এলাকায় পানিতে আটকে পড়েন। কোমর পানির কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের না গিয়ে অগত্যা বাসায় ফিরে যান তিনি।
শাহবাজ লিটন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ১৪ সড়ক এলাকায় পানি ওঠায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এসময় শত শত লোক পায়ে হেঁটে বহদ্দারহাট এলাকায় পৌঁছে। সেখান থেকে ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা গুণে মুরাদপুর আসতে হয়। আবার সেখান থেকে আরও ২০ টাকা গুণে ষোলশহর ২নং গেটে এলাকায় পৌঁছাতে হয়।
ইপিজেডের ভেতরে বৃষ্টির পানি হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে জানিয়ে প্যাসেফিক জিন্সের কর্মরত মোহাম্মদ সুজন জানান, অনেক কষ্ট করে ইপিজেডের ভেতরের হাঁটু জল পেরিয়ে আগ্রাবাদ, লালখান বাজার হয়ে কর্নেলহাট এসেছি। অনেকে এখনো অফিসে আটকে আছে।
চট্টগ্রাম-হাটহাজারি সড়কের মুরাদপুর থেকে আতুরার ডিপো পর্যন্ত এবং কাপাসগোলা রোড, কেবি আমান আলী রোড, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের কে বি ফজলুল কাদের চৌধুরী রোড, প্রবর্তক মোড়, শুলকবহরসহ প্রায় সব এলাকা জলমগ্ন বলে জানানা ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যম হালিশহর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। ঢাকা ট্রাংক রোডে দুপুর ২টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। বৃহত্তর হালিশহর ছাড়াও আগ্রাবাদ, বেপারিপাড়া, হাজিপাড়া, মোল্লাপাড়া, সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্রধান সড়কগুলো কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। এসব বিভিন্ন এলাকায় ডিঙি নৌকায় মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)-এর একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)-এর দুইটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। আগামী বছরের জুনে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।