২০২১ সালের ২৫ আগস্ট বেলা ১১ টার দিকে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জলাবদ্ধ পানিতে ডুবে থাকা রাস্তায় হাঁটার সময় খোলা নালায় পড়ে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী ছালেহ আহমেদ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার লাশের হদিস পাওয়া যায়নি।
এরপর ওই বছরই কয়েক মাসের ব্যবধানে একে একে খোলা নালায় আর খালে পড়ে প্রাণহানি ঘটে কলেজ ছাত্রী সাদিয়া, শিশু কামাল, সিএনজি চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগমের। সর্বশেষ সোমবার (৭ আগস্ট) চসিকের এক নম্বর ওয়ার্ডে খোলা নালায় পড়ে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো আরেক প্রাণ। এই ঘটনায় যেন মনে করিয়ে দেয় চসিকের খোলা নালা এখনো মৃত্যুকুপ।
স্থানীয়রা জানান, গত বৃহসপতিবার থেকে চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। এর মধ্যে সোমবার (৭ আগস্ট) সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর এক নম্বর ওয়ার্ডে হাটহাজারী ফতেহপুরের নন্দীরহাট এলাকায় খোলা নালায় পড়ে নিপা পালিত নামে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু ঘটে। নিপা পালিত ওই এলাকার উত্তম পালিতের মেয়ে। তিনি হাটহাজারী সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, নিপার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। নাজিরহাট কলেজে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য তিনি সকালে বাসা থেকে বের হন। তার বাসার সামনে তখন রাস্তায় পানি জমেছিল। বাসা থেকে একটু সামনে যাওয়ার পর ডুবে থাকা নালায় পড়ে যান। এরপর স্থানীয় লোকজন তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।
নগরবাসীর মতে, এত প্রাণহানির পরেও হুঁশ ফিরছেন না নগরীর দায়িত্বে থাকা প্রধান দুই সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। এখনো অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের অধিকাংশ খাল ও নালা। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার সময়ে খালে পড়ে মৃত্যুর মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও তা এড়াতে এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ।
এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসীর প্রশ্ন আর কত প্রাণহানি হলে হুঁশ ফিরবে নগর দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই দুই সেবাসংস্থার দায়িত্বশীলদের। যদিও দায় কাঁধে নেওয়া সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি অরক্ষিত খাল-নালায় নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নালায় পড়ে মৃত্যুর দায় আমাদের। দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যে বসে আছি ব্যাপারটা ঠিক তা না। আমাদের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। খাল-নালায় পড়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত, দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার বর্ষার মৌসুমে এমন জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছি। এই ঘটনার আরও বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নিবো। একইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ যেসকল খাল-নালা রয়েছে সেগুলোতে অতিসত্তর লাল পতাকা বা সাইনবোর্ড টাঙানোর ব্যবস্থা করবো।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, চসিকের নির্ধারিত খোলা নালায় স্ল্যাব স্থাপন এবং খালের পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আমাদের তালিকা তৈরি হলেও বর্ষার আগে নানা কারণে অনেক জায়গার কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত ও নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ খালের পাড়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার বর্গফুট রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ওয়ার্ডে এখনও অন্তত ৩ হাজার মরণফাঁদ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, দুই নম্বর গেট, রহমান নগর, মেয়র গলি, আল-ফালাহ গলি এলাকার নালার বেশির ভাগ অংশে এখনও স্ল্যাব বসানো হয়নি। এমনকি বড় বড় খালেও নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী।
অথচ ২০২১ সালে ব্যবসায়ী ছালেহ আহমদের মৃত্যুর পর এ ঘটনায় দায় নিয়ে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেছিল দুই সরকারি সংস্থা চসিক ও চউক। তখন এ ঘটনা তদন্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে। সাত সদস্যের ওই কমিটি ওই বছরের ১ নভেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে কর্তৃপক্ষ হিসেবে চউক ও সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হয়।
সেসময় প্রতিবেদন জমার পর নিজেদের দোষারোপ না করে সুর পাল্টে খাল-নালায় পড়ে প্রাণহানির ঘটনায় দুই সংস্থার কেউই দায়ী না বলে মন্তব্য করেছিলেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। পরবর্তীতে অনেকটা নিজের গরজে নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সেসময় নগরের কতটি নালা-খাল খোলা তার হিসেব আয়ত্ত্বে আনতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। ওই সময়ে চসিক মেয়র জানুয়ারির (২০২২) মধ্যে বিপদজনক খোলা ড্রেনের কাজ শেষ করার তাগাদা দিয়েছেন। সেই তাগাদাও কিন্তু একসময় ঝিমিয়ে পড়ে।
চসিকের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম নগরে চসিকের আওতায় ৯৭২ কিলোমিটার নালা রয়েছে। ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাত এবং ৫৭টি (১৬১ কিলোমিটার) খাল। এই ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টিই সিডিএর আওতাধীন। বাকি ২১টি খাল দেখভালের দায়-দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আবার বেশিরভাগ ফুটপাত নালার ওপর। সেখানেও দখলদারদের হানা। ২০২১ সালে এ সকল খাল, নালা ও ফুটপাতের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর উপর জরিপ চালায়। জরিপের পর মোট ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়। এসকল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মোট আয়তন ছিল ১৯ কিলোমিটার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রক্ষায় দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি।