বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

বৃষ্টির অজুহাতে চট্টগ্রামে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি

ব্যবসায়ীদের আচরণে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা

blank
print news

টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত চট্টগ্রাম। যার বিরুপ প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারেও। জলাবদ্ধতায় খেত নষ্ট ও পরিবহন সংকটে সরবরাহ কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চট্টগ্রামের সকল পণ্যের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

ক্রেতারা বলছেন, নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে পকেটের হিসাব মিলাতে পারছেন না তারা। প্রয়োজনের তুলনায় অল্প নিত্যপণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এমন আচরণে অনেক ক্রেতা ক্ষুব্দ। এ জন্য সরকারি সংস্থাসমূহের নিরবতাকে দায়ী করছেন ক্রেতারা।

ক্রেতাদের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার রক্ষার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।

জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, সাধারণ ক্রেতাদের পকেট কাটা এখন ব্যবসায়ীদের পেশা। যা একেবারে ওপেন সিক্রেট। ব্যবসায়ীরা গত ৩ আগস্ট থেকে টানা ৬ দিনের বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রাম মহানগরে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন-চারটি উপজেলায় বন্যার অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন।

অথচ এর আগে অনাবৃষ্টির অজুহাতে সবজি উৎপাদন কম হওয়ার কথা বলে দাম বাড়িয়েছেন। কোরবানির ঈদের আগের রাতেও তারা কাচামরিচের কেজি ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রী করেছেন। এ সময় প্রশাসন ছিল নিরব। যার কারণে ব্যবসায়ীদের স্পর্ধা বেড়ে গেছে। যেখানে যায় সেখানে সিন্ডিকেট। সেখানে রাজনৈতিক পরিচয়।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাজারে গেলে দেখা যায় সবজি বিক্রেতা সিন্ডিকেটের অমুক ক্ষমতাসীন দলের এই সংগঠনের এই নেতা। এভাবে বাজারে প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ ক্রেতার পকেট কাটছে। অথচ এক সময় আমরা দেখেছি, বন্যাসহ নানা দুর্যোগে মানুষ অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাড়াত। ব্যবসায়ীরাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখত। সে সময় এখন আর নেই। এখন আমরা সামাজিক অবক্ষয়কাল অতিক্রম করছি।

ক্রেতারা জানান, গত এক সপ্তাহ আগের তুলনায় শনিবার (১২ আগস্ট) সকালে নগরীর সবকটি হাটবাজারে সবজি, মুরগি-ডিম, মাছসহ সবরকম নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ টাকার নিচে কোন বাজারে মিলছে না সবজি। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি বেগুন এখন ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০, পটল ৬০, করলা ১০০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, কচুর ছড়া ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

৪০ টাকা বেড়ে কাকরল ১০০ টাকা, ঢেঁড়শ ১০০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, গাঁজর ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে মিষ্টি কুমড়া ও লাউ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ বিক্রয় করা হচ্ছে ২৫০ টাকায়।

সবজির দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজীর দেউড়ি বাজারের সবজি বিক্রেতা এমরান হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়েছে। যার ফলে বাজারে সবজির সরবরাহে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তাই পাইকারি বাজারে সব ধরনের সবজি বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে। যার কারণে খুচরা বাজারে সবজির দাম চড়া।

এদিকে কর্ণফুলী ও কাজীর দেউড়ি বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ২০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায় এবং সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা দরে। তবে হালিশহর, ঈদগাঁ এলাকার স্থানীয় বাজারগুলোতে ১৮০ টাকা দরে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি কর্ণফুলী বাজারে প্রতিকেজি হাঁড় ছাড়া গরুর মাংস ৯৫০ টাকা ও হাঁড়সহ গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

কর্ণফুলী বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা মো. জাফর বলেন, প্রতিকেজি গরুর মাংস আমাদের ৮০০ টাকা কেনা পড়ে। ৯০০ টাকার উপরে বিক্রি করতে না পারলে আমাদের লোকসান হয়। কারণ আমাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিতে হয়। একই বাজারে মুরগি বিক্রেতা রেজাউল করিম বলেন, বাজারে সব সময় ব্রয়লার মুরগির চাহিদা থাকে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার কারণে এ সপ্তাহে মুরগির সরবরাহ কম। তাই বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।

মাছের বাজারেও মিলছে না স্বস্তি। নগরীর বহদ্দারহাটে প্রতিকেজি পাবদা মাছ ৫০০-৫৫০ টাকা, ছোট আকারের রুপচাঁদা মাছ ৭০০ টাকা ও বড় আকারের রুপচাঁদা মাছ ১০০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি ছোট তেলাপিয়া ২০০, পাঙ্গাশ ২০০ থেকে ২২০, আকারভেদে প্রতিকেজি রুই ২৬০-৩২০, কাতল আকারভেদে ৩২০-৪০০, মৃগেল ২২০, কোরাল ৮০০ ও চিংড়ি ৬৫০-৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে এক থেকে দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ১৪০০-২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত। কাজীর দেউড়ির মাছের বাজারেও দামে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

এদিকে জলাবদ্ধতা ও পরিবহন সংকটে সরবরাহ কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি দোকানে পানি ঢুকে পড়ায় নিত্যপণ্যের অনেক কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মালামাল তেমন আসছে না- যার ফলে নিত্যপণ্যের সাময়িক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে দাম বেড়েছে।

শনিবার সকালে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদা, রসুন পেঁয়াজে দাম বেড়েছে মানভেদে কেজিপ্রতি ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত। আমদানি করা আদা গত সপ্তাহে ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে-যা এখন কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়ে ১৮০-২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করা চীনা রসুনের দাম কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি করা হচ্ছে ২০০-২১০ টাকায়।

প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ এখন ৬৮-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকা দরে। এভাবে চাল, ডাল, লবণ, শুকনো মরিচ, হলুদ, আটাসহ প্রায় নিত্যপণ্যের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫-৭ টাকা। এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, পেঁয়াজের সরবরাহ না থাকায় দামটা একটু বাড়তি।

এদিকে ভোজ্যতেল সয়াবিন ও চিনির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও ওইদামে কোথাও মিলছে না এসব পণ্য। শনিবার বাজারে চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়, অথচ সরকার নির্ধারিত দাম হচ্ছে ১২০ টাকা। বাজারে পাম তেল বিক্রি হচ্ছে লিটার প্রতি ১৬০-১৭০ টাকায়। অথচ সরকারের নির্ধারিত দর ১৩৩ টাকা। সে হিসেবে প্রতি লিটার পাম তেলের দাম বাড়তি নিচ্ছে ২৭-৩৭ টাকা।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ স¤পাদক মো. ইদ্রিছ বলেন, কয়েকদিনের বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে পেঁয়াজের সরবরাহ কম ছিল। তাছাড়া বন্দরে জাহাজ ভিড়তে পারেনি। যার ফলে পেঁয়াজ, আদা, রসুনের দাম একটু বাড়তির দিকে। আশা করছি তিন চারদিনের মধ্যে সরবরাহ বাড়লে দাম আবার কমে যাবে।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

নগরীর বহদ্দারহাটে বাজার করতে আসা নজরুল ইসলাম নামের এক এনজিও কর্মকর্তা জানান, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। এক সপ্তাহ আগে যে সবজি ৩০ টাকায় কিনেছি তা আজকের বাজারে ৬০ টাকার চেয়ে বেশি। একটি পণ্যের দাম কমলে দুইটি পণ্যের দাম বাড়ে। মাসের আয় দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছি।

বাজার করতে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল আলম বলেন, হঠাৎ করে ব্যবসায়ীরা জলাবদ্ধতার অজুহাত দেখিয়ে সব পণ্যের দাম বাড়তি নিচ্ছে। এভাবে নানা ইস্যুতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর চিন্তা করলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বাজারে আসা যাবে না।

কাজীর দেউড়ি বাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো মহিউদ্দিন জুয়েল বলেন, বন্যার অজুহাতে সব ধরনের সবজিতে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। লাল ডিম ডজনে ২৫ টাকা বেড়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোরবানের সময় কিছুটা কমলেও এখন ১৯০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে। বাজারের এ মাথা থেকে ওমাথা হাঁটছি। দাম শুনে কি কিনবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আহমদ শরীফ নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দখলে নিত্যপণ্যের বাজার। জলাবদ্ধতা ও সরবরাহ সংকট একটি অজুহাত মাত্র। ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

ক্রেতাদের ভাষ্য, সংকট থাকুক বা না থাকুক ব্যবসায়ীরা ইস্যু পেলেই কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ক্রেতাদের জিম্মি করে ফেলেছে ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এসব কারসাজির পেছনে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এলেও কোনো শাস্তি হতে দেখিনি। বাজার ব্যবস্থাপনার কোনো নীতিমালা ও নিয়মিত তদারকি না থাকার কারণে বাজারের পরিবেশ অমানবিক হয়ে ওঠছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page