শিল্পী তালুকদার (৩০) পেশায় চাকরিজীবী। শিল্পীকে অফিসের সহকর্মীরা প্রলোভন দেখান, ২০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে ভালো আয় হবে। চটকদার প্রলোভনে পড়ে ‘এমটিএফই’ অ্যাপস ডাউনলোড করে তথ্যভান্ডারে ভোটার আইডি কার্ড, মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। সর্বশেষ তার অ্যাকাউন্টে ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
গত ৭ আগস্ট থেকে অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং বা বাইন্যান্সের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে দেখেন অ্যাপসটি বারবার আপডেট চায়। একপর্যায়ে বলা হয় ত্রুটির কারণে সমস্যা হচ্ছে। শিগগিরই অ্যাপসটি পুনরায় চালু হবে। দিন যতই যায় ততই সমস্যা ঘনীভূত হতে থাকে। একপর্যায়ে এমটিএফইর অ্যাপস থেকে টাকা উত্তোলন করতে চাইলে তা পারছিলেন না শিল্পী।
তখন তিনি বুঝতে পারেন এটি একটি প্রতারণামূলক অ্যাপস। তিনি প্রতারকদের খপ্পড়ে পড়েছেন। সোমবার অ্যাপসটি চালু করার কথা থাকলেও ওই তথ্য ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার আগেই রোববার দেখা যায় উল্টো শিল্পী তালুকদারের কাছে ডলার দাবি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোম্পানি বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসানের মুখে পড়েছে। বাকি ডলার পরিশোধ না করা হলে জেল খাটতে হবে।
এভাবে শিল্পীর মতো এমন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী প্রতারণার শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বুস্ট করে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছিল এমটিএফই। দেশের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে এমটিএফই বাইন্যান্স ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নামে কোনো লেনদেন ছিল না। এ ধরনের এমএলএম বা বেটিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী সাইটগুলো মনিটরিং করবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। কিন্তু সেটি বিটিআরসি না পারায় সাধারণ মানুষ লোভে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকেরও। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে এত অর্থ দেশ থেকে পাচার হচ্ছে কিংবা অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে তার দেখভাল করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা করেনি। অপরদিকে বিটিআরসির অভিযোগ, ক্ষতিকর অ্যাপস সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত করে জানালে বিটিআরসি ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
জানা গেছে, ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা নিয়ে গত এক বছরে অ্যাপের মাধ্যমে এমটিএফই দেশে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে লাপাত্তার বিষয়টি বুঝতে পারে গ্রাহকরা। তাদের তথ্য মতে, ৭০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এখনও কোনো গ্রাহক আইনগত কোনো সহযোগিতা চায়নি। থানায় কোনো অভিযোগ করেনি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুল রহমান আজাদ বলেন, এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে আমরা জানতে পেরেছি। তবে এখনও আমাদের কাছে কোনো গ্রাহক অভিযোগ করেননি। আমরা নিজ উদ্যোগেই এই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি।
তিনি বলেন, এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে পুরোটাই হয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। এমটিএফই অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহকরাও পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছেন। আর ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে বাইন্যান্স ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এই অ্যাপসের মূল হোতাদেরও বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রতারণার শিকার সুরাইয়া ইসলাম নামের এক তরুণী বলেন, দুই সপ্তাহ আগে সিস্টেম আপগ্রেডের মাধ্যমে সমস্যার শুরু হয়। এর পর থেকে অ্যাপস থেকে কোনো টাকা উত্তোলন করতে পারছি না। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে অ্যাপসটি ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে। তারা জানায় স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের পর বিপুল লোকসান হয়েছে। রোববার পুরোপুরি কার্যক্রম বন্ধ দেখায়।
তিনি বলেন, আমাদের বলা হয়েছে এমটিএফই কানাডায় নিবন্ধিত সংস্থা। শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ভারতসহ অন্তত ৩০টি দেশে এর কার্যক্রম ছড়িয়েছে। সুরাইয়া বলেন, অ্যাপটিতে কেউ ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন তাকে লাভ দেওয়া হতো প্রায় ১৩ ডলার। তখন বলা হতো, এত অল্প বিনিয়োগ হলে তো আর বড় লাভ আসবে না। বিনিয়োগ যত বেশি, লাভের পরিমাণও তত বেশি দিত অ্যাপটি। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মাঝেমধ্যে লোকসানও দেখানো হতো। এ জন্য ৫ হাজার, ১০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন অনেক গ্রাহক। বিনিয়োগের ওপর সব মিলিয়ে মাসে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ পাওয়া যেত। কেউ ৫০১ ডলার বা ৫৮ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১৬ টাকা ধরে) বিনিয়োগ করলে তার প্রতিদিন লাভ আসত প্রায় ১৩ ডলার বা ১ হাজার ৫০০ টাকা।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, বিটিআরসি টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি। এখানে আমাদের সরাসরি মনিটরিং করার মতো সুযোগ নেই। এসব ক্ষতিকর অ্যাপস সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত করে জানালে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এর বাইরে আর্থিক লেনদেন বা অপরাধের বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে। অবৈধভাবে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা বন্ধ করা গেলেই এ ধরনের অপরাধ রোধ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।