বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

নির্দলীয় সাংবাদিকতাই পারে বিভাজন দূর করতে

blank
print news

একটা সময় ছিল যখন ছাপানো পত্রিকা পড়ার জন্য পাঠকরা ব্যাকুল হয়ে থাকত। দেশ ও দশের খবর জানার দুটি উপায় ছিল-এক রেডিও, দুই সংবাদপত্র। টেলিভিশন ছিল কেবল বিনোদনের যন্ত্র। টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা হয়েছিল নাটক, গান, নাচ ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু খবরের কাগজ বা পত্রিকা পকেটের টাকা দিয়ে কিনে পাঠক পড়ত। খবরাখবর জানত। পাড়ায়, মহল্লায় লাইব্রেরিতে পত্রিকা সংগ্রহ করা হতো। যেখানে দলবদ্ধভাবে খবর জানার ইচ্ছাটা দৃশ্যমান ছিল। কেউবা রাস্তার বিক্রেতার কাছ থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ে ফেলত।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিক ছোঁয়ায় এমন দৃশ্য এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। হাতের মোবাইল ডিভাইসে এখন সব দেখা যায়, পড়া যায়। পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ পাঠকের ইচ্ছাকে হাতের মুঠোয় ভরে দিয়ে বিশাল পত্রিকাকে সংগ্রহ করে পড়ার আগ্রহকে হত্যা করেছে। আর কেনইবা পকেটের টাকা খরচ করে পত্রিকা কিনে পড়া। মোবাইল ডিভাইস তো ফ্রি পড়তে দিচ্ছে। এটা ঠিক যে, পত্রিকা কিনে পড়ার পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমলেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি পাচ্ছে। যদি হিসাব করা হয় যে, মোট কতটা দৈনিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশের বৈধ অনুমতি পেয়েছে, প্রকাশ হচ্ছে এবং তার সার্কুলেশন চিত্রটা কেমন, গুণগত অবস্থাইবা কেমন। তা হলে বিস্ময়কর কিংবা লজ্জাকর কোনো তথ্য পাওয়া যাবে বলে অনেকেই মনে করে। যত্রতত্র সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পত্রিকা অফিসের অস্তিত্ব দেখানো হয়। কিন্তু আদতে এসব জায়গায় কী হয়, আর কেনইবা রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এসব খোলা হলো, তার কোনো দেখভালের প্রয়োজন কোথাও আছে কি না, বোধ হয় কি না তা কেউ জানে না, জানতে পারে না। তবে এসবের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে, যা সবাই জানতে পারে না।

যা হোক, প্রিন্টিং পত্রিকা পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার আরও একটি অন্যতম কারণ রয়েছে বলে অনেকেই মনে করে। একসময় ছিল যখন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণেই সাংবাদিকতার পেশা নিবেদিত ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, পরিবর্তন এসেছে। প্রায় প্রতিটি পেশার ক্ষেত্রে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণবোধটা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করলেই এই পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়। ফলে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের চেয়ে প্রায় সব ধরনের পেশাজীবীসহ সাংবাদিকতা পেশা বা সাংবাদিকদের কাছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলের স্বার্থ উদ্ধারে সাংবাদিকরা বেশি মগ্ন, নিবেদিত। যেসব স্বার্থে আবার ব্যক্তির স্বার্থ সুপ্ত থাকে। খোঁজ করলে এমন অনেক সাংবাদিক পাওয়া যাবে যারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এবং রাজনৈতিক ফায়দা ও সুবিধা নিতে সদা সক্রিয়। আর সেই কারণে সম্ভবত এক সময়কার ছাপোষা সাংবাদিকদের খেতাব পরিবর্তিত হয়েছে। সাংবাদিকতা পেশা মানেই হলো এখন ধনদৌলতে ভরপুর।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

সোজাসাপ্টায়, প্রায় প্রতিটি পত্রিকাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে কাজ করে বলে সাধারণ পাঠকের ধারণা। ফলে নিরপেক্ষ ও প্রকৃত সংবাদ পরিবেশন করার সুযোগ আর থাকে না। সেদিকে অধিকাংশ সাংবাদিক হাঁটে না। হাঁটার সুযোগও নেই। সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে অতিরিক্ত মোহের কারণে। আবার পত্রিকার মালিক যারা, তারা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি কিংবা গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা এখন প্রায় দুর্লভ বিষয়।

নিজেদের দলীয় সংবাদ প্রচারের জন্য কোনো কোনো রাজনীতিকের নিজস্ব প্রকাশনা ও পত্রিকা থাকায় সাংবাদিকতার অতীত ঐতিহ্য, রূপ ও সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রের কল্যাণে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সাংবাদিকতা এখন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে প্রভাবিত করে না।

উপরন্তু বিভেদ, বিভাজনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে প্রচারমাধ্যমের ব্যবহার আছে বলে কারোর কারোর অভিমত রয়েছে।আবার রয়েছে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব পত্রিকা। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে বা থাকবে। সংবাদ পরিবেশন করার নিদের্শনা মূলত তারাই দিয়ে থাকে। ফলে ন্যায়সংগত, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের সংস্কৃতি আর থাকে না, কেউই চর্চা করার কথাও ভাবে না। সবকিছুই যেন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীনিষ্ঠ। ফলে জানার সুযোগ নেই বলেই পাঠকরা পত্রিকা পড়ে কোনো ঘটনার প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টাও করে না। কাগজের পত্রিকার প্রতি নিরুৎসাহিত হওয়ার এটা একটা বড় কারণ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রতিটি চ্যানেল যেন এক একটি রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে। সর্বসাধারণের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশনের দায়বদ্ধতা নেই। প্রচারমাধ্যম মানেই যেন কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীর তথ্য প্রচারের অন্যতম এক হাতিয়ার।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

আমার জানা নেই যে, সংবাদ পরিবেশনের জন্য এমন কোনো নীতিমালা রয়েছে কি না যে, দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে না, এমন সংবাদ পরিবেশন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। অসত্য সংবাদ পরিবেশনও একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও সচরাচর যা দেখা যায় তা হলো, কেউ কারোর সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ উপস্থাপন করলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থকে বড় করে দেখা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যে লাগাতার সব সংবাদ পরিবেশিত হয় বা হচ্ছে, তা রোধে আদতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় বা হচ্ছ-এমন প্রশ্ন অনেকেরই। এমন কিছু অজনপ্রিয়, অপ্রচলিত পত্রিকা রয়েছে যেখানে মিথ্যা, বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করা হয়, সেই সবইবা কে দেখে, কে দেখছে। এখানে অবশ্য কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। যেমন, যার বা যাদের দেখার কথা, তারা কতটা বিধিসম্মত ও নিরপেক্ষভাবে দেখে, রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা ভাবে। সাধারণ মানুষ মনে করে, দেখার সব চোখ তো আর নির্দলীয় নয় কিংবা থাকছে না।

দেশের ভেতর যে এত রাজনৈতিক অনৈক্য, দ্বন্দ্ব, হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিশোধপরায়ণতা-এর সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন পেশার ভেতর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও আগ্রাসন। রাজনীতির বীজ বিভিন্ন পেশার ভেতর এতটাই বপন করা হয় এবং রাজনৈতিকভাবে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে পরিচালিত করা হয় যে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন। ফলে পেশার গুণগতমান আর থাকে না, দেশপ্রেম থাকে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক মতাদর্শের লড়াইটা মুখ্য হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতাও এর ঊর্ধ্বে থাকছে না।

এটা তো ঠিক যে, সব ধরনের পেশা ও পেশাজীবী সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। যার সবটাই রাষ্ট্রের কল্যাণে বা স্বার্থে। আর রাষ্ট্রের কল্যাণ বা স্বার্থ মানেই হলো-রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণ ও স্বার্থ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনৈতিক চেতনায় দল বড় হয়ে গেছে। দলের স্বার্থ ও কথা ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই, আকুতি নেই। নেই ব্যতিব্যস্ততা। শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে সংবাদপত্র, হাসপাতাল, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান-সর্বত্র রাজনৈতিক আগ্রাসন। অনেকের প্রশ্ন, এমন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তির ভেতর দেশপ্রেম জাগবে কী করে? ঐক্যইবা জাগ্রত হবে কী করে!

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

সংবাদপত্রকে যে কাঠামোয় ও আদর্শে নেওয়া হয়েছে তাতে সামাজিক চেতনা জাগাতে পারাটা কঠিন হবে বলে কেউ কেউ মনে করে। তারপরও সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, অন্তত সঠিক ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, কল্যাণ করে-এমন তথ্যই প্রচারের দায়িত্ব নিক প্রচারমাধ্যমগুলো। যদিও তা কতটা সম্ভব হবে, বলা যায় না। তবে এখনও যারা আদর্শগতভাবে সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নিয়েছেন তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকতে পারে, রাষ্ট্রই তাদের কাছে বড় এবং তার কল্যাণ, সুরক্ষা নিশ্চিত করাই একমাত্র দায়। এতে ব্যক্তি তারসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আমরা রাজনৈতিক দলীয় সাংবাদিকতা চাই না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চাই। যাদের কাছে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা মুখ্য। দলীয় চিন্তা, চেতনা কখনোই যেন দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে না যায়। এমন প্রবণতা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বিভেদ, বিভাজন সৃষ্টি করে।

রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সবার ভেতর ঐকমত্য তৈরি করা জরুরি, যা সাংবাদিকরা পারেন তাদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন দ্বারা। প্রচারমাধ্যম অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাড়ে, জনমনে শক্তি ও সাহস জন্মে। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যদিও কারোর কারোর মতে সমাজে নিরপেক্ষ বলে কোনো শ্রেণি নেই বা থাকে না। তারপরও বলি, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা অত্যন্ত জরুরি সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে। যে নিরপেক্ষতা বোধ সঠিক সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিককে সাহস জোগাবে। আর জনগণ তার চেতনাকে সেদিকে ধাবিত করতে অনুপ্রাণিত হবে। দেশপ্রেম একটা চর্চার বিষয়, যা ব্যক্তির বিশ্বাসে জাগ্রত হয়। সাংবাদিকরাই পারেন সেই বিশ্বাসকে জাগিয়ে দিতে।

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page