সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের বাজারেও বেড়েছে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম। এ নিয়ে চলছে চরম অস্থিরতা। এর মধ্যে রয়েছে এক সময়ের সহজলভ্য ডাব। বর্তমানে বাজারে ১৫০ টাকার নিচে কোন ডাব মিলছে না। আকার ভেদে ২৫০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে ডাব।
তার চেয়েও বেশি দামে ডাব বিক্রয় হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের আশপাশে। সেখানে ৩০০ টাকায়ও বিক্রয় হচ্ছে ডাব। ডাবের দাম বাড়ায় গরম বেড়েছে বিক্রেতাদেরও। যেন দাম তারা যা বলে তাই।
দামাদামির চেষ্টা করলে বিক্রেতা এমন ভাব, যেন তিনি কোন কথাই শুনছেন না। অন্যদিকে ডাব কিনতেই হবে ক্রেতার। কারণ ডাক্তার বলে দিয়েছেন ডেঙ্গু রোগীদের ডাব খাওয়াতে। এ সুযোগে ডাবের ওপর বদনজর পড়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের। এমন মত ভুক্তভোগীদের।
ভুুক্তভোগী ক্রেতা সাধারণ জানান, চট্টগ্রামের সবকটি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের পথ্য হিসেবে ডাব খাওয়াতে বলেছেন ডাক্তাররা। সাথে ডিম ও পালং শাকসহ আরও দুই-তিনরকম খাদ্য পণ্য। তম্মধ্যে হাসপাতালের পাশে মিলে ডাব। কিন্তু এ সুবাধে ডাব অন্য যে কোন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিনগুণ-চারগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
অভিযানে যার প্রমাণ পেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার। অভিযানের কথা শুনে অনেক বিক্রেতা ডাবের ভ্যান ফেলে পালিয়ে যান।
তবে এ সময় ক্রয়মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ডাব বিক্রি ও অবৈধভাবে মজুদ করায় দুই বিক্রেতাকে ৩০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মো. ফয়েজ উল্ল্যাহ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, চমেক হাসপাতালের সামনে এক বিক্রেতা মাত্র পাঁচটি ডাব বিক্রি করছিলেন। প্রতিটি মাঝারি আকারের ডাব সে ২০০ টাকায় বিক্রয় করছিল। এছাড়া শুধুমাত্র ৫টি ডাব দেখে সন্দেহজনক মনে হলে বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে ডাব মজুদের কথা স্বীকার করে। পরে একটি ফার্মেসির পিছনে কয়েকশ ডাব মজুদ করে রাখার তথ্য দেয় সে। ডাব মজুদ করে রাখার অপরাধে ওই দোকানিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অন্যদিকে আরেক বিক্রেতা ৬০ টাকায় কেনা ডাব ১৫০ টাকা বিক্রয় করায় তাকে পাঁচশ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া হাসপাতালের ডাবের আরও বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান দোকান থাকলেও ভোক্তা অধিকারের অভিযানের খবরে ভ্যান রেখে পালিয়ে যায় বিক্রেতারা।
মো. ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় কয়েকগুণ চাহিদা বেড়েছে ডাবের। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে জিম্মি করছেন রোগী ও তাদের স্বজনদের। অভিযানে এসে আমরা প্রমাণও পেয়েছি।
ডাব যখন ডেঙ্গু রোগীর পথ্য :
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গু উপসমে ডাব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। এটি রক্তের প্রøাটিনেট বাড়ায়। ফলে ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসায় পথ্য হিসেবে ডাব খেতে বলা হয়েছে রোগীদের।
কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের রক্তে প্লাটিনেট দ্রুত কমে যায়। ফলে ডাবের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। এই সুযোগে ডাব ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যা মোটেই উচিত নয়। দু:খ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মানুষ ক্রমেই মানবিকতা হারাচ্ছে। এক সময় যে কোন দুর্যোগে মানুষ এগিয়ে আসত। আর এখন দুর্যোগের সুযোগে মানুষ পকেট কাটছে। এটা সামাজিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মত প্রকাশ করেন চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, চমেক হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ জনের উপরে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকে। সে হিসেবে দৈনিক ৩০০-৪০০ ডাবের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের চারপাশে কমপক্ষে ২০-২৫ জন ডাব বিক্রি করে থাকেন। এদের একেক জনের কাছে একশরও বেশি ডাব মজুদ থাকে। কিন্তু তারা ডাব সংকট দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রয় করে।
গাছের ৩০ টাকার ডাব শহরে ১৫০ টাকা :
চট্টগ্রামের ১৫ টি উপজেলা থেকে মূলত ডাব আসে চট্টগ্রাম শহরে। শহর এলাকা থেকে তেমন ডাব মিলে না। আর চট্টগ্রামে ডাবের পাইকারি বাজার হচ্ছে ফিরিঙ্গি বাজার। যেখান থেকে ডাব কিনে পুরো চট্টগ্রাম শহরে বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা।
চমেক হাসপাতালের সামনে খুচরা ডাব বিক্রেতা মনছুর আলম বলেন, ফিরিঙ্গি বাজার থেকে ছোট আকারের প্রতিটি ডাব ৬০ টাকায় কিনি আমরা। এই ডাব খুচরা ১৫০ টাকায় বিক্রয় করি। মাঝারি আকারের ডাব ৯০ টাকায় কিনি। খুচরায় বিক্রয় করি ২০০ টাকায়। বড় আকারের ডাব ১২০-১৩০ টাকায় কিনি। খুচরা বিক্রয় করি ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত। এই টাকায় বিক্রয় না করলে সংসারের খরচ উঠানো যায় না।
তিনি বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে দাম, তার খরচ মেটাতে হলে একজন মানুষকে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা কামাই (আয়) করতে হবে। অন্যথায় সংসার চালানো যাবে না। নিজের সংসার বাচানোর জন্য তো আর রোগীর কথা ভাবলে চলবে না। হাসপাতালের ডাক্তাররা কি রোগীর কথা ভাবে? উল্টো প্রশ্ন করেন তিনি।
ক্রেতারা জানান, মূলত ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পর থেকেই ডাবের চাহিদা বেড়েছে। বিক্রেতারা যে দামই হাঁকছেন ডেঙ্গু রোগীর জন্য সে দামেই ডাব কিনতে বাধ্য হচ্ছেন স্বজনরা। তবে হাসপাতালের সামনে বাড়তি দাম হলেও পাড়া মহল্লায় ডাবের দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।
ফিরিঙ্গি বাজার ডাবের পাইকারি আড়তদার সেলিম উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামে একদিকে তাপপ্রবাহ চলছে। অন্যদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ডাবের চাহিদা বেড়েছে। আগে যে ডাব আমরা ২০-২৫ টাকায় গাছ থেকে কিনে আনতাম, সে ডাব এখন ৩০-৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার উপর পরিবহণ খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। গাছ থেকে ডাব কিনে শহরে আনতে প্রতিটি ডাব ৫০ টাকার উপরে গিয়ে পড়ছে। যা ৬০ টাকা থেকে আমরা বিক্রয় করছি। আর এই ডাব খুচরা পর্যায়ে এত বেশি দামে বিক্রয়ের কথা নয়। খুচরা ব্যবসায়ীদের থামানো উচিত।
ভোক্তা অধিকারের চট্টগ্রাম সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, ডাবের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে থাকার কথা থাকলেও সেই ডাব বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। যা একেবারেই উচিত নয়। ১০০ টাকার বেশি দামে ডাব বিক্রির কোনো অভিযোগ পেলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ভোক্তা অধিকার।