চট্টগ্রামে নিন্মবিত্তদের মুখে ফলের স্বাদ নেওয়া দুরূহ হয়ে গেছে অন্তত আরও ১০ বছর আগে। তখন সেটা গিয়ে ঠেকেছিল মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। আর এখন সেই মধ্যবিত্তের কপালেও জুটছে না রসালো ফল। কতিপয় উচ্চবিত্তের খাবার হয়ে গেছে এখন এই ফল। তাই এই ব্যবসাও এখন তলানিতে। এতে দিশেহারা ব্যবসায়ীরাও।
সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ফলের খুচরা বাজার বহদ্দারহাট, ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, আগ্রাবাদ, পাহাড়তলি ও পাইকারি ফলের বাজার রেয়াজুদ্দিন বাজারের ফলমন্ডির ব্যবসায়ীরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রামের ফলের বাজারে এখন বিদেশি কোন ফল নেই। দেশি ফলেই চলছে এই ব্যবসা। আর দেশি ফল বিদেশি ফলের মতো সুমিষ্ট ও মানসম্মত না হওয়ায় ক্রেতাও নেই। তাছাড়া বিদেশি ফলের সংকটে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে দেশি ফলের দাম। ফলে মধ্যবিত্ত যারা ফলের ক্রেতা ছিলেন তারা আর ফল কিনছে না। এখন উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে ফল কিনতে আসছেন।
ফল ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ফলের ব্যবসার ধস শুরু হয় চলতি বছর ফেব্রæয়ারি মাসের শুরু থেকে। এ সময় ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্র) খোলার জটিলতায় ফল আমদানিতে নিরুৎসাহের কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এরপর থেকে ফলের বাজার অস্থির হতে শুরু করে। এই সময় মাত্র দুই-তিন দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ফলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
এ অবস্থায় রমজানে খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফলও পায়নি ক্রেতারা। তখন থেকে দেশি ফল বিক্রী করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ফলের ব্যবসার পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফল ব্যবসায়ীরা এখন প্রায়ই পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
বহদ্দারহাটের যুমনা ব্যাংক মার্কেটের নিচ তলার খুচরা ফল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, দেশের পাইকারি বাজারে এখন দেশে উৎপাদিত আপেল, মাল্টা, আঙ্গুর, কমলা, আম, কলা, পেয়ারা ছাড়া আর কোন ফল নেই। তাও আবার চাহিদার তুলনায় অনেক কম। দোকান প্রায় খালি। ফলে দামও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, বাজারে এখন আপেল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায়, অথচ বিদেশি আপেল বিক্রয় হয়েছিল ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়, মাল্টা বিক্রয় হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৪০ টাকায়। বিদেশি মাল্টা বিক্রয় হয়েছিল ১৪০ টাকায়। আঙ্গুর বিক্রয় হচ্ছে ৬০০ টাকায়। বিদেশি আঙ্গুর বিক্রয় হয়েছিল ২০০ টাকায়। এছাড়া আমের কেজি ৩০০ টাকায়, পেয়ারার কেজি ১৫০ টাকায়, কলা ডজন ২৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে এখন। এভাবে ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারাও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
নগরীর চকবাজারের খুচরা ফল ব্যবসায়ী আবুল ফজলও বলেন একই কথা। তিনি বলেন, বাজারে ফল নেই। তাই ফলের দাম প্রায় দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে নিন্মবিত্ত দূরের কথা, মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত ফল খেতে পারছে না।
ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারের ফলমন্ডির পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরাও। পাইকারি ফল ব্যবসায়ী তসকির আহমেদ বলেন, চায়না থেকে ফল আমদানি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ফল আমদানি বন্ধ রয়েছে। ফলে বাজারে বিদেশি আপেল, মাল্টা, সবুজ আঙ্গুর, কালো আঙ্গুর, নাশপাতি, বেদনা, ম্যান্ডারিন, ড্রাগন, সাম্মাম, বিদেশি জাতের আম কিছুই নেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে বিদেশি ফলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এই সময়ে বাজারে আমদানি করা ফল না থাকায় শুধুমাত্র দেশি ফল দিয়ে বাজারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাজারে সব ধরনের ফলের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। অন্যদিকে ক্রেতা না থাকায় মার খাচ্ছে ফল ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ফলের মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভারত, ভুটান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মিসর, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান ও ফ্রান্স থেকে আপেল, মাল্টা, কমলা, নাশপাতি ও আঙ্গুর আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের সংকট ও এলসি জটিলতার প্রভাব পড়েছে ফল আমদানিতে। ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ফল আমদানি ৩০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বিদেশি ফলের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রেফার কনটেইনারে করে বেশির ভাগ কমলা, আঙ্গুর, ম্যান্ডারিন, নাশপাতি ও আপেল আমদানি হয়। গত ৭ মাসে এসব ফলের আমদানি কমেছে প্রায় ৫৮ হাজার টন।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩১ হাজার টন, ফল আমদানি হয়েছে। সর্বশেষ গতবছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৯৩ হাজার ৩৭২ টন কমলা, আঙ্গুর, ম্যান্ডারিন, নাশপাতি ও আপেল আমদানি হয়েছে। এই সময়ে সব মিলিয়ে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৬ টন ফল।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ১৭ লাখ কেজি ফল বেচাকেনা থেকে প্রায় ২৮ কোটি টাকা আয় আসে ফল ব্যবসায়ীদের। দুই ঈদের সময় দৈনিক ফলের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে প্রায় ৩৪-৩৫ লাখ কেজিতে উঠে। কিন্তু আমদানি কমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফলের বাজার অস্থির হয়ে উঠে।
তিনি বলেন, ডলার সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) জটিলতার প্রভাব ছিল এতদিন। এখন সরকার বিদেশি ফল আমদানিতে নিরুৎসাহিত করায় আমদানি একেবারে কমে গেছে। ফলে দেশিয় ফলের উপর নির্ভর করে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ফল ব্যবসায়ীরা পথে নামবে।
বাংলাদেশ ফ্রেস ফ্রুটস ইপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে উৎপাদিত ফলে যোগান দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। বাজারে বিদেশি ফল না থাকলে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে। সমস্যা নিরসনে বিদেশি ফল আমদানি স্বাভাবিক করা জরুরি।