চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে যানজট নিরসন এবং ঢাকা অভিমুখী যানবাহনগুলোকে শহর থেকে বের হওয়ার জন্য সহজ রাস্তা করে দেওয়ার লক্ষ্যে বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। যার আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে মাত্র ৬ কিলোমিটার সড়ক।
১৯৯৬ সালে শুরু করা এই প্রকল্প শেষ হয়নি এখনও। ফলে এটিকে আজব এক প্রকল্প মনে করছেন খোদ চউকের অনেকেই। একই সঙ্গে এই সড়ক ভয়ঙ্কর সড়ক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে চট্টগ্রামের জনমনে। কারণ অল্প বৃষ্টিতেও এই সড়কের ওপর ধসে পড়ে পাহাড়। ঘটে নানা দুর্ঘটনা।
সড়কটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও খুলে দেওয়া না হলেও গত দুই বছর ধরে চলছে নানা যানবাহন। এরমধ্যে প্রাইভেটকারই বেশি। সড়ক দিয়ে কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছেন এমন একজন চট্টগ্রাম মহানগরীর দুই নম্বর গেইট আবাসিকের বাসিন্দা শিপ ইয়ার্ড ব্যবসায়ী মনসুর আহমেদ।
তিনি বলেন, দুই নম্বর গেইট থেকে ঢাকা মহাসড়ক পর্যন্ত মাত্র ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে ২৭ বছর পার করে দিয়েছে চউক। এখনও সড়কের কাজ শেষ করতে পারেনি। পাহাড়ের বুক চিরে সড়কটি মেরামত করা হয়েছে। সড়ক দিয়ে যেতে মনে হয় খাড়া কাটা পাহাড় গিলে খাচ্ছে।
এছাড়া অল্প বৃষ্টিতে খাড়া পাহাড় ধসে পড়ে সড়কের ওপর। এভাবে আসা যাওয়ার পথে অনেক গাড়ি ধসে পড়া পাহাড়ের মাটিতে চাপা পড়েছে। ঘটেছে প্রাণহানিও। প্রতিবছর বর্ষায় ধসে পড়া মাটিতে সড়ক চলাচল বন্ধও হয়ে পড়ে বহুবার। ফলে এই সড়ক দিয়ে যেতে-আসতে মনে ভয় সঞ্চার হয়। এতে এই সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়া করতে মন চায় না। তবে অনেক সময় নিরুপায় হয়ে যানজট থেকে বাচতে ও সময় বাচাতে এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।
একই কথা বলেন নগরীর নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সরোজ আকবর। তিনি বলেন, সীতাকুন্ডে ব্যবসা থাকায় প্রায় আসা-যাওয়া করতে হয়। আগে দুই নম্বর গেইট থেকে জিইসি-টাইগারপাস হয়ে ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে আসা যাওয়া করতাম। এতে সময় লাগত দুই ঘন্টা। এখন এই সড়কে আসা-যাওয়া করতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। কিন্তু সড়কটি পাহাড় কেটে করায় ভয়ঙ্কর সড়কে পরিণত হয়েছে। সড়ক নির্মাণকারী সংস্থা চউক গত ২৭ বছর ধরে এই সড়ক নির্মাণ করলেও শেষ করতে পারেনি এখনও। ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ করতে এত সময় লাগার কোনো কারণ নেই। এতে এই প্রকল্পটিকে আজব এক প্রকল্প মনে হচ্ছে।
সড়কে যাতায়াতকারী ব্যক্তিদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়ক-মহাসড়ক কোনটিতে টোল নেই। এমনকি বহদ্দারহাট, কদমতলি, দেওয়ানহাট মোড় এবং মুরাদপুর উড়াল সড়কেও টোল আদায় করা হয় না। অথচ মাত্র ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বায়েজিদ লিঙ্ক রোডে বসানো হচ্ছে টোল।
এ নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা রহস্য। নানা জনের মনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। কারণ এই রোডে টোল আদায়ের কারণ স্পষ্ট করেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। বিষয়টি অনুসন্ধানে মিলেছে-এই সড়ক তৈরির সময় পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদফতরের কাছে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ জরিমান গুণতে হয়েছে সরকারি এই সংস্থাকে। যা উশুল করতে বসানো হচ্ছে টোল।
সূত্রমতে, এই সড়ক দিয়ে চলতে মোটরসাইকেলকে টোল দিতে হবে ১০ টাকা। টোল হার তিন চাকার গাড়ির ক্ষেত্রে ১৫ টাকা, প্রাইভেট কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের ক্ষেত্রে ৫০ টাকা, পিকআপ ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ৮০ টাকা। তাছাড়া এই রোডে বড় বাস চলাচলে ১০০ টাকা, চার চাকার ট্রাকের ক্ষেত্রে ১২০ টাকা এবং ছয় চাকার ট্রাকের ক্ষেত্রে ১৫০ টাকা টোল দিতে হবে। কাভার্ড ভ্যান চলাচলে সবচেয়ে বেশি ২০০ টাকা টোল দিতে হবে।
টোল আদায়ের বিষয়টি নিয়ে চউকের অনেক কর্মকর্তার মুখেও নানা সমালোচনা প্রচার পাচ্ছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তেমন কোনো কথা বলছেন না। বিষয়টি জানতে চাইলে এই সড়ক প্রকল্পের পরিচালক ও চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব দাশ বলেন, পাহাড়ের বুক চিরে মাত্র ৬ কিলোমিটার সড়কপথ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ কারণে পরিবেশ অধিদফতর ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করে। এর আগেও দুই দফায় ১০ লাখ টাকারও বেশি জরিমানা করে। যা দিতে হয় চউককে। তবে এ কারণে সড়কে টোল বসানো হয়েছে কিনা তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই।
চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, প্রকল্পের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। ৫ শতাংশ মতো কাজ বাকি আছে। কাজগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র পাহাড় ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত। বর্ষায় পাহাড়ধস ঠেকাতে এই ব্যবস্থাপনা দরকার।
তিনি বলেন, নানা কারণে এই প্রকল্পের কাজ স¤পন্ন করা সময়সাপেক্ষ হয়েছে। বহুদিন পর পর এসে বদলে যায় প্রকল্প। ফলে দুবার বদলাতে হয় নকশা, বাড়ে ব্যয়, এরপরও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। দুই যুগের বেশি সময় পার করে দেওয়া হয় এই প্রকল্পে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় আগামী বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সড়কটি এখনো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। তবে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও বায়েজিদ লিংক রোড দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। সড়কের টোল হারও নির্ধারণ করা হয়েছে।
চউকের তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে হাতে নেওয়া হয় এই সড়ক নির্মাণের প্রকল্প। ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বারবার হোঁচট খায় চউক। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নতুন করে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
সড়কের নকশায় পরিবর্তনও আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন হয়। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০ টাকা।
গত বছরের আগস্ট মাসে আরেক দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৩৫৩ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে ৩৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সড়কটিতে টোল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চউক।
নগরীর বায়েজিদ সংযোগ সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের এই হাল সম্পর্কে চউক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের জরিমানা, পাহাড় ব্যবস্থাপনা ও রেললাইন-সংক্রান্ত জটিলতাসহ নানা কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও খরচ দফায় দফায় বেড়ে যায়। বর্তমানে শুধু পাহাড় ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক জটিলতা প্রকল্পের শতভাগ কাজ সম্পন্ন করতে বাধা হয়ে রয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও ওই সড়ক দিয়ে নিয়মিত যানবাহন চলাচল করছে।