বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

তলানিতে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য

চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙর জাহাজ শূণ্য

print news

দেশের বাজারে আমদানি পণ্যের দামে আগুন লেগেছে অনেক আগেই। যা ক্রমেই ছড়াচ্ছে দেশীয় পণ্যেও। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের পাতে উঠছে না এখন দেশে উৎপাদিত আলুসহ নানা সবজিও। এমনকি খামারে লালিত মুরগি ও ডিম পর্যন্ত খেতে পারছে না সাধারণ মানুষ।

আর এসবের মুলে সংকটের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের এসব কথা বিশ্বাসও করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। কারণ বাজারে চোখের সামনে সাজানো পণ্য দেখছেন সবাই। কিন্তু বাজারে পণ্য সংকটের তথ্য মিলেছে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, তলানিতে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। এতে প্রায় স্থবির চট্টগ্রাম বন্দর। এক সময়ে পণ্যবাহি জাহাজে ঠাসা চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙরে এখন নেই অপেক্ষমান কোন জাহাজ। এমনকি পণ্য খালাসে জেটিতে নেই জাহাজের কোন ভিড়।

বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি জাহাজ চলাচল কমে গেছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের কোন কোনদিন একইসাথে তিনটি কন্টেইনার জেটি খালি থাকার মতো ঘটনা ঘটছে। বহির্নোঙরে নেই অপেক্ষমাণ একটি জাহাজও। বিদেশ থেকে যে কয়েকটি জাহাজ কন্টেইনার নিয়ে আসছে সেগুলো সরাসরি জেটিতে বার্থিং নিচ্ছে।

বন্দরকেন্দ্রিক ব্যস্ততা কমে যাওয়া মানে হলো দেশের আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া। আর আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া মানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়া। এর কারণ হতে পরে ডলার সংকটের প্রভাব। মাঝে কায়েকমাস আমদানি-রফতানি বাড়লেও সম্প্রতি কমেছে। যার ফলে বন্দরে জাহাজ আসাও কমেছে। তাই জাহাজ আসা-যাওয়া বাড়াতে ব্যসায়িক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা পণ্যবাহি জাহাজের সংখ্যা অনেক আগেই কমে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরে খোলা পণ্যবাহি জাহাজের সংখ্যা কমলেও প্রতিটি কন্টেইনার জেটিতে জাহাজ থাকত। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে কন্টেইনার জাহাজের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। আমদানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরে জাহাজ আসার পরিমাণ কমছে।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

বন্দরের বার্থিং রিপোর্টের তথ্যমতে, চলতি মাসের ৩ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ নম্বর জেটি খালি ছিল। ৬ সেপ্টেম্বর জাহাজ থাকলেও পরদিন এই জেটি আবার খালি হয়ে যায়। ১০ সেপ্টেম্বরে বন্দরের ৯ ও ১০ নম্বর জেটিতে বার্থিং দেওয়ার মতো জাহাজ ছিল না। ১১ ও ১৪ সেপ্টেম্বর আবার ১১ নম্বর জেটি খালি হয়ে পড়ে। ১৭ সেপ্টেম্বর ১০, ১১ ও ১৩ নম্বর জেটি খালি ছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর বন্দরের ১০ ও ১১ নম্বর জেটি জাহাজশূন্য ছিল।

বন্দরে ১০টি জেটিতেই কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই-তিনটি জেটি শূন্য থাকার ঘটনা উদ্বেগের বিষয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন। এছাড়া সেপ্টেম্বরের গত ১৯ দিনে বন্দরের বহিনোঙরে অপেক্ষমাণ কোন জাহাজ নেই। সিঙ্গাপুর, কলম্বো কিংবা মালয়েশিয়া থেকে কন্টেইনার নিয়ে আসা জাহাজগুলো সরাসরি বন্দরের জেটিতে বার্থিং নিচ্ছে। এতে জাহাজকে অলস বসে ক্ষতিপুরণ গুণতে হচ্ছে না। কিন্তু জেটি খালি থেকে যাওয়ায় বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিস্থিতিকে নেতিবাচক বলে দেখছেন ব্যবসায়ী ও বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভর মৌসুম বিরাজ করলেও এবার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। বাজেট পরবর্তী সময়ে আমদানি বাণিজ্যে নতুন গতি আসার কথা। কিন্তু এবার আমদানি-রফতানি বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি থেকে বেশ দূরে রয়েছে। বন্দরে জাহাজের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও বহির্নোঙর শূন্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে একটা সময় ছিল যখন জাহাজ এসে ৫-৬ দিন অলস বসে থাকতে হতো। সেই দিন এখন আর নেই। একটি জাহাজ একদিন অলস বসে থাকলে ১২-১৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ গুণতে হতো। তবে এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। বন্দরে জাহাজ এসে সরাসরি ভিড়তে পারছে। এমনকি বন্দরের জেটি খালিও থাকছে। সেটি কিন্তু আবার দেশের বাণিজ্যের জন্য ভালো খবর না।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

তিনি আরও বলেন, বন্দরকেন্দ্রিক ব্যস্ততা কমে যাওয়া মানে হলো দেশের আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া। আর আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া মানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়া। এর কারণ হতে পরে ডলার সংকটের প্রভাব। মাঝে কায়েকমাস আমদানি-রফতানি বাড়লেও সম্প্রতি কমেছে। যার ফলে বন্দরে জাহাজ আসাও কমেছে। তাই জাহাজ আসা-যাওয়া বাড়াতে ব্যসায়িক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সারা বিশ্ববাণিজ্যেই এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা করোনায় একবার পিছিয়েছিলাম। সেই কাটা দাগ শুকানোর আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাবে ডলার এবং বাণিজ্য সংকট সৃষ্টি হয়। এসবের মধ্যেও প্রতিযোগিতার বাণিজ্যে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, ব্যবসা কমে গিয়ে অনেক কারখানা অলস দিন কাটাচ্ছে। অর্ডার না থাকায় কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন পড়ছে না। আর ডলারের উচ্চমূল্যে কাঁচামাল কিনবে কিনা সেই চিন্তাও করতে হয় কারখানাগুলোকে। আবার একেবারে ঠেকায় পড়ে আমদানির চিন্তা করলেও দেখা যায় ব্যাংকগুলো ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। এসবের কারণে ব্যবসা কমেছে। আর ব্যবসা কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর স্থবির হয়ে পড়েছে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরাও বলছেন একই কথা। এই বাজারের আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. মহিউদ্দিন বলেন, সবকিছুর আমদানিই কমে গেছে। জরুরি না হলে কোনো পণ্য আনা হচ্ছে না। ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্র আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের ঝুঁকি বিরাজ করছে। অনেক আমদানিকারক ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছেন। আবার ভোক্তা পর্যায়ে জিনিসপত্রের ব্যবহার কমেছে। আগের তুলনায় অন্তত ২০-২৫ শতাংশ পণ্য কম ব্যবহার হচ্ছে, যা আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

তিনি আরও বলেন, আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্য সংকট চলছে। এই চাপ দেশীয় পণ্যের উপরও পড়েছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক সংকট এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডলার সংকটের কারণে কোনো ব্যাংকে এলসি খোলার স্বাভাবিক গতি নেই। শতভাগ মার্জিন দিয়ে এলসি খুলতে হচ্ছে। যেটি অসম্ভব ব্যাপার। এতে করে আমদানির স্বাভাবিক গতি নেই।

প্রসঙ্গত, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের অন্তত ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। এই বন্দরে ১৩টি সাধারণ বার্থ, চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনালে (সিসিটি) ৩টি জেটি, নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে ৫টি জেটি, ২টি ডলফিন জেটি এবং ৬টি রিভার মুরিং জেটি মিলে বন্দরে একই সাথে ৩২-৩৩টি জাহাজ বার্থিং দেওয়া যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭টি মূল জেটির মধ্যে ১ নম্বর জেটি অকার্যকর। ২ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত জেটির মধ্যে ১২ নম্বর জেটিতেও জাহাজ ভিড়ানো হয় না। সাধারণ কার্গো বার্থের ১১টিতে জাহাজ বার্থিং দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭টি জেটিতে খোলা পণ্যবাহি জাহাজ এবং বাকি ৪টিতে কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং দেওয়া হয়। এছাড়া সিসিটির ২টি এবং এনসিটির ৪টি মিলে ১০টি জেটিতে কন্টেইনার জাহাজ ভিড়ানো হয়। কিন্তু কন্টেইনার জাহাজের চাপ বেড়ে গেলে জেনারেল কার্গো বার্থে একটি জেটি কন্টেইনার জাহাজের জন্য দেওয়া হয়। এনসিটি ১ নম্বর জেটিতে শুধুমাত্র পানগাঁও টার্মিনালের জাহাজ ভিড়ানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি এবং এনসিটির সবগুলো জেটিতে কী গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে। বাকি জেটিগুলোতে শোর হ্যান্ডলিং ক্রেন দিয়ে কার্গো এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এতে সারাবছর সরগরম থাকে চট্টগ্রাম বন্দর।

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page