স্বাস্থ্য সেবায় এক সময় খুব সুনাম অর্জন করেছিল চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে অবস্থিত শেভরণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেই সুনাম কিন্তু এখন আর নেই। বরং উল্টো মৃত্যুকুপে পরিণত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। স্বাস্থ্য সেবার নামে দিনের পর দিন যেভাবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ভূল রিপোর্টসহ নানা কারসাজির তথ্য মিলছে তাতে প্রতিষ্টানটি ডা. কদমআলীর চেম্বারে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রোগ নির্ণয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা আদায় ও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট (স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রণ) ব্যবহার, আট বছর আগে মারা যাওয়া চিকিৎসকের নামে রিপোর্ট সরবরাহসহ ভুল রিপোর্টের মতো ভয়াবহ তথ্য মিলেছে।
গুরুতর এমন একাধিক অভিযোগ চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জমা পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ফলে বেপরোয়া ভুল রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের ভুল রিপোর্টের কারণে মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি পঙ্গু হওয়ার নজিরও রয়েছে। মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে সংশ্লিষ্টদের এমন নিরবতা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন সমাজকে।
সূত্রমতে, সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট রোকেয়া বেগম নামের এক রোগীকে শেভরণের দেওয়া ইকোকার্ডিওগ্রাফির রিপোর্টে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউলের নাম উল্লেখ ছিল। অথচ ওই চিকিৎসক মারা গেছেন ৮ বছর আগে। কিন্তু তার নামে রিপোর্ট দিয়েছে শেভরণ। এই ব্যাপারে অভিযোগও জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসে।
গত ১ মে পেটের ব্যথা নিয়ে শেভরণের জরুরি বিভাগের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আলট্রাসনোগ্রাফি ও এক্স-রে করান আমান উল্লাহ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এরপর ডাক্তার রিপোর্ট দেখে এপেন্ডিসাইটিস বলে শনাক্ত করেন এবং অপারেশন করানোর জন্য বলেন। পরে অন্য হাসপাতালের আরও দুই চিকিৎসকের পরামর্শে আবারও টেস্ট করান আমান। টেস্টে এপেন্ডিসাইটিসের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায় পিত্তথলীতে পাথর।
তারও আগে ২০২২ সালের আগস্টের শুরুর দিকে শেভরণ ও এপিকের দেওয়া ক্যান্সার শনাক্তের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন করা হয় আইনুর নাহার সীমা নামে এক গৃহবধূকে। অপারেশনের পর সীমার শরীর পাওয়া টিস্যু চট্টগ্রামেরই অন্য একটি বিশেষায়িত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, সেখানে ক্যান্সারের কোনো উপস্থিতিই নেই। কিন্তু অপারেশন-পরবর্তী তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওই গৃহবধূ ১৯ আগস্ট মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
গত ১৭ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ফি আদায় করায় অভিযোগে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। একদিন পর আবার ল্যাবটি খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় ল্যাবটির বিরুদ্ধে ৩০০ টাকার পরিবর্তে ডেঙ্গু এনএস ওয়ান পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৬০০ টাকা ও আইজিজি বা আইজিএম পরীক্ষার ফি ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছিল।
এছাড়া গত বছরের ২২ সেপ্টম্বর শেভরণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অথচ শেভরণ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির ফ্রিজেও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। কিন্তু এরপরও থেমে নেই শেভরণের ‘দুই নম্বরি’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করলে টেস্টে যথাযথ রিপোর্ট আসবে না। এমন রিপোর্টের ওপর চিকিৎসা নিলে রোগীর শারীরিক অবনতি হবে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। শেভরণে এমন অনিয়মের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। তবুও প্রতিদিন বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে, এমনকি বন্ধের দিনেও অভিযান চলছে। অভিযোগের ভিত্তিতে শীঘ্রই আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।’
চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘শেভরণের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করছি। প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তাদের বিরুদ্ধে ডেঙ্গু টেস্টে বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল। ওই অভিযোগের কারণে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’
অভিযোগের বিষয়ে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের জেনারেল ম্যানেজার পুলক পারিয়াল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অভিযোগের বিষয়ে আমরা জানি না। এমন কোনো চিঠি সিভিল সার্জন অফিস থেকে আমাদের কাছে আসেনি।’ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।