#ভুয়া প্রকল্পের নামে বরাদ্দ নিয়ে বাইরে বিক্রি
#প্রতিটনে অতিরিক্ত লাভ ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা!
।। ইব্রাহিম খলিল ।।
আমদানি করা বিটুমিনের চেয়েও মানসম্মত চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) উৎপাদিত বিটুমিন। অন্য যে কোন বিটুমিনের সঙ্গে ইআরএলের বিটুমিন মিশিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। ফলে ইআরএলের বিটুমিনের চাহিদা বেশি। এতে এই বিটুমিনে হামলে পড়েছে সংঘবদ্ধ শকুনের দল।
এ দলে জড়িত খোদ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) থেকে শুরু করে তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল, ইএলবি ও ইআরএলের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী। যাদের সহযোগীতায় বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পের নামে লুন্ঠন চলছে বিটুমিনের।
আর এসব বিটুমিন সরকার নির্ধারিত মুল্যের চেয়েও টনপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রয় করে দেয়া হয় চোরাই মার্কেটে। যেখান থেকে বিটুমিন কিনে উন্নয়ন কাজ চালায় অনেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এভাবে বাড়তি আয়ের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন অভিযোগ বিটুমিন সরবরাহে নিয়োজিত প্রকৃত ঠিকাদারদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে দেশের জ্বালানি খাতে নৈরাজ্য চলছে। জ্বালানি তেল ও এলপিজির পাশাপাশি বিপিসি নিয়ন্ত্রাণাধীন প্রতিষ্ঠান ইআরএলে উৎপাদিত বিটুমিন নিয়েও চলছে চরম অরাজকতা।
এ নিয়ে বিপিসির পরিচালক অনুপম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সরকারি বিটুমিন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে।
গত ১৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে জ্বালানি ও খনিজস¤পদ বিভাগকে বিষয়টি অবহিত করে। এরপর অনুপম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও জ্বালানি বিভাগকে অবহিত করার জন্য ৩০ এপ্রিল বিপিসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগের উপসচিব একেএম মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করতে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হককে দায়িত্ব দেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। কিন্তু তিন মাস পরও তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় এ নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ উঠেছে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং যিনি তদন্তের দায়িত্ব পান তারা দু‘জনই সরকারের যুগ্ম সচিব।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, মোহাম্মদ ইউসুফ ওরফে ইউসুফ আলী ও তার সহযোগীরা বিপিসির এক শীর্ষ কর্মকর্তার প্রভাব খাটিয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এশিয়াটিক অয়েল ও ইএলবির মাধ্যমে ইআরএলে উৎপাদিত বিটুমিন ছাড়িয়ে নেন। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, সড়ক ও জনপদ বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ভুয়া বরাদ্দপত্র তৈরি করা হয়।
যার সাথে জড়িত বিপিসির কর্মকর্তা ও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এশিয়াটিক অয়েল ও ইএলবির মহাব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে গঠিত বিটুমিন বরাদ্দ কমিটি। যাদের সহযোগীতা করেন এসব প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তারা।
এসব কাজে চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তারা এক থেকে দুই হাজার টাকা অবৈধ আয়ের সুযোগ পেলেও মোটা অঙ্কের ভাগ চলে যায় বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপকদের পকেটে। তবে সবচেয়ে বড় অংক চলে যায় বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের পকেটে।
যার সত্যতা মিলেছে বিটুমিন কারসাজির সাথে জড়িত কয়েকজন ঠিকাদারের কথায়ও। ঠিকাদাররা বলেন, আমরা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এশিয়াটিক অয়েল ও ইএলবির নিবন্ধিত ঠিকাদার। কিন্তু গত ৫-৬ বছর ধরে দেখছি আমরা বিটুমিন পাচ্ছি না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নামে ভুয়া প্রকল্পের বরাদ্দপত্র দেখিয়ে অনেক ঠিকাদার বিটুমিন ছড়িয়ে নিচ্ছে।
ঠিকাদাররা বলেন, এক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি। তিনি থাকেন ঢাকায়। তার আরও অন্তত চারজন সহযোগী রয়েছেন যারা আলাদা কিংবা কখনো এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে বিটুমিন কারসাজি করেন। তারা হলেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আলী লিটন, মোহাম্মদ কামরুল, মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও মোহাম্মদ পারভেজ।
আর তাদের সুপারিশে নেওয়া বিটুমিন বিক্রী করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে। আর এই বিটুমিন উন্নতমানের হওয়ায় তারাও টনপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা বেশি দামে ক্রয় করেন। কারণ এই বিটুমিনের সাথে মানহীন অন্য বিটুমিন মিশিয়ে কাজ করা যায়। ফলে ইআরএলের বিটুমিন নিরুপায় হয়ে কিনেন তারা।
ঠিকাদারদের ভাষ্য, ইআরএলের এক ট্রাক বিটুমিন মানে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা অতিরিক্ত আয়। এভাবে দিনে বিভিন্ন বিপণন সংস্থা থেকে অন্তত ২০ ট্রাক বিটুমিন ছাড়াতে পারলে লাভ ৫০ লাখ টাকা। মাসে আয় অন্তত ১০-১২ কোটি টাকা। যার সিংহভাগ চলে যায় বিপিসি ও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এশিয়াটিক অয়েলে, ইএলবি এবং ইআরএল কর্মকর্তাদের কাছে। যার মাধ্যম হচ্ছে ইউসুফ।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে ইউসুফ বিটুমিনের সাথে কোনভাবে যুক্ত নয় বলে জানান। তবে পরে সাংবাদিক পরিচয় গোপন অন্য মুঠোফোন নাম্বারে কথা হয় ইউসুফের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে তো অনেকেই মাল কিনে। একাজে তো আমি একা নয়, যে কো¤পানি থেকে বিটুমিন নেবেন সেই কো¤পানির এমডি, ইআরএল ও বিপিসির লোকজন আছে।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইআরএল এবং বিভিন্ন কো¤পানিকে ম্যানেজ করে বিপিসি। তারা তো বিপিসির কথা ছাড়া সিরিয়ালে হাত দিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে আমি কাকে ব্যবহার করব সেটা আমার বিষয়। আমি চাইলে সবকিছু করতে পারি। তবে বেশি মাল নিলে আপনাকে সহযোগিতা করব।
ইউসুফের সহযোগী মোহাম্মদ আলী লিটন বলেন, বিটুমিন দেওয়া যাবে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এশিয়াটিক অয়েল থেকে আমরা মাল বের করে দিব। আর ইউসুফ ভাইকে তো চিনেন। তার সঙ্গে আমার ভালো রিলেশন। একসঙ্গে ব্যবসা করি। উনি যেহেতু আছেন ইনশাল্ল¬াহ সিরিয়াল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বাকি আল্লাহ ভরসা।
লিটন বলেন, বিটুমিন ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে টাকা দিতে হবে। টাকা না দিলে কাজ হয় না ভাইজান। ২৩ বছর ধরে ব্যবসা করছি। এ লাইনে ব্যবসা করে অনেকে আজ কোটিপতি। কিন্তু আমি এখনো ফকির। চিটারি, বাটপারি করি না। কাউকে খারাপ পরামর্শ দিই না।
লিটন আরও বলেন, বিপিসির তিনজন পরিচালকের মধ্যে একজনকে ম্যানেজ করতে হবে। এটা নিয়ে সমস্যা হবে না। ডকুমেন্ট ছাড়া মাল নিতে হলে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেবেন। যেকোনো একটা কো¤পানি থেকে আপনাকে মাল দেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া বলেন, বিটুমিন ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট অনেক পুরোনো। আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এজন্য বিটুমিনের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে তদবির না আসে। তারপরও দেখছি তদবির আসছে। হয়তো এখনও কেউ কেউ জড়িত। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, বিটুমিন সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় দালাল রয়েছে। তারা অনেক সময় মন্ত্রীর পিএস দিয়ে ফোন করান। অন্য বিভিন্ন জায়গা থেকেও তদবির আসে। আমরা সবসময় গ্রাহ্য করি না। আবার অনেক সময় তদবির রাখতেও হয়। এ নিয়ে আমরা খুবই বিব্রত। আর ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে নীতিমালায় বিটুমিন সরবরাহ ও বিপণন চলছে, তা অটোমেশন প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে কমিটির প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। অটোমেশনের আওতায় চলে আসলে আর কোনরকম অনিয়মের সুযোগ থাকবে না।
সূত্র জানায়, বিপিসির বিটুমিন পেতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সরকারি প্রকল্প হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যক্তিকে বিটুমিন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী কিংবা প্রকল্প পরিচালক প্রতিনিধি মনোনয়ন করে। এজন্য প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারের প্রতিনিধির ছবি, নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মনোনীত প্রতিনিধির নমুনা সই সত্যায়িত করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে প্রত্যয়ন দেন প্রকল্প পরিচালক। ওই প্রতিনিধি বিপিসির বিপণন কো¤পানিগুলো থেকে বিটুমিন নিয়ে প্রকল্পের স্থানে পৌঁছে দেন। প্রত্যয়ন সঠিক কি না-তা যাচাইয়ের দায়িত্ব থাকে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটির।
আর প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেসরকারি বিটুমিন ব্যবসায়ী ও কমিশন এজেন্টরা সরকারি বিটুমিন ব্যবসায় জড়িয়েছেন। তারা বিপণন কো¤পানি ও বিপিসির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে এক প্রকল্পের নামে বিটুমিন নিয়ে অন্য ঠিকাদারের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করেন। সরকারি এসব বিটুমিন বেশি দামে কিনলেও গুণগত মানের কারণে বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিপিসিতে ৮০-১০০ ও ৬০-৭০ দুই গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদিত হয়। বাল্কে ও ড্রামজাত করে বিটুমিন সরবরাহ করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। বর্তমানে ৮০-১০০ বিটুমিনের প্রতি ড্রামের মূল্য ১২ হাজার ৩০০ টাকা, বাল্কে প্রতি টনের মূল্য ৭৬ হাজার টাকা। ৬০-৭০ গ্রেডের প্রতি ড্রামের মূল্য ১২ হাজার ৮০০ এবং বাল্কে টনপ্রতি দর নির্ধারিত আছে ৭৯ হাজার ৩০০ টাকা। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দর কার্যকর করে বিপিসি।
ড্রামজাত বিটুমিনের হিসাবে প্রতি ট্রাকে ৮৫ ড্রাম করে বিটুমিন সরবরাহ দেয় বিপণন কো¤পানিগুলো। বিটুমিন বরাদ্দ পাওয়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ছাড়া কো¤পানিগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবে বিটুমিন পাওয়া যায় না। বিটুমিনের দাম সম্প্রতি ওঠা-নামা করছে। এতে প্রতি ট্রাকে ৯০ হাজার থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের প্রতি ট্রাকের জন্য ১০ লাখ ৮৮ হাজার টাকার পে-অর্ডার হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। অতিরিক্ত টাকা নগদ পরিশোধ করা হয়। অতিরিক্ত এসব টাকা কো¤পানি থেকে বিপিসির বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয় বলে জানান ঠিকাদাররা।
এ বিষয়ে জানতে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটির আহ্বায়ক ও পদ্মা অয়েল কোম্পানীর জিএম (মার্কেটিং) শহীদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে প্রায় ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক আরাফাতুল ইসলাম বলেন, বিটুমিন বরাদ্দ নিয়ে আমি কোনো পার্টির (ঠিকাদার) কাছ থেকে কখনও এক গ্লাস পানিও খাইনি। এমনকি হজ্ব থেকে আনা জমজম কুয়ার পানিও আমি গ্রহণ করিনি।
এসএওসিএলে ১২ বছর ধরে কমিটিতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মীর মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১১ সাল থেকে আমি বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে আছি। নিজ থেকে বিটুমিন বরাদ্দ দিতে পারি না। মণি লাল স্যার (কো¤পানির সিইও ও বিপিসির মহাব্যবস্থাপক) যেভাবে বলেন, সেভাবে বিটুমিন দিই। নির্ধারিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপনি (প্রতিবেদক) মণি লাল স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।
জানতে চাইলে এসএওসিএলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিপিসির মহাব্যবস্থাপক মণি লাল দাশ বলেন, প্রকল্পের বরাদ্দ অনুযায়ী ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে প্রাপ্তি সাপেক্ষে নিয়ম অনুযায়ী আমরা বিটুমিন সরবরাহ দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয় না।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে আছেন সহকারি ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক মিয়াজি। তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালক কিংবা নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিনিধি মনোনয়ন দেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। আর এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) থাকলে, মনোনয়ন দেওয়া হলে তাদেরও বিটুমিন সরবরাহ দিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সংঘবদ্ধ চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যান।
ইএলবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, প্রকল্প পরিচালক কিংবা নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিনিধি মনোনয়ন দেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। আর এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) থাকলে, মনোনয়ন দেওয়া হলে তাদেরও বিটুমিন সরবরাহ দিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। একই ব্যক্তি একাধিক ঠিকাদারের প্রতিনিধি হলে কোনো অনিয়ম হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি।
বিপিসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৮-১০ লাখ টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বিটুমিন উৎপাদিত হয় ৬০-৬৫ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী-বিপিসির জ্বালানি বিপণনকারী অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কো¤পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল কো¤পানি, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কো¤পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) এবং ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেড (ইএলবিএল) এ বিটুমিন সরবরাহ করে। বিটুমিন সরবরাহের জন্য প্রত্যেক বিপণন কো¤পানির নিজেদের বিটুমিন বরাদ্দ কমিটি রয়েছে।
এক্ষেত্রে সড়ক বিভাগের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জোন এবং খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নকাজের বিটুমিন দেওয়া হয় পদ্মা অয়েল কো¤পানির মাধ্যমে। সড়ক বিভাগের রংপুর ও রাজশাহী জোন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আওতাধীন জেলা এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনকে বিটুমিন সরবরাহ দেওয়া হয় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে।
সড়ক বিভাগের খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ জোন এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন জেলাগুলোতে বিটুমিন দেওয়া হয় যমুনা অয়েল কো¤পানির মাধ্যমে। সড়ক বিভাগের সিলেট জোন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের জেলাগুলো এবং সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, বন্দর কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা ও গণপূর্তের জন্য বিটুমিন দেওয়া হয় এসএওসিএলের মাধ্যমে। এছাড়া গাজীপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের জন্য বিটুমিন বরাদ্দ দেয় ইএলবিএল।
এদিকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিনের সরবরাহে প্রকৃত গ্রাহকদের বিটুমিন প্রাপ্যতা এবং যথাযথ প্রকল্পে ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে বিদ্যমান নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিপিসি। কমিটিতে বিপিসির বিপণন বিভাগের পরিচালককে আহ্বায়ক করা হয়। এ কমিটিকে মতামতসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত ২৮ ডিসেম্বর বিপিসির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় নীতিমালা পর্যালোচনা কমিটি।
প্রতিবেদনের একাংশে উল্লেখ করা হয়, একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্প ও কাজের বিটুমিন বিতরণকারী কোম্পানি থেকে সরবরাহ নিয়ে থাকে। ফলে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে একাধিকবার বিটুমিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মর্মে জনমনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
আরেক অংশে উল্লেখ করা হয়, প্রায়ই মূল ঠিকাদার বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে বিটুমিন না নিয়ে তার প্রতিনিধি মনোনয়ন দেন। ওই প্রতিনিধি কো¤পানি থেকে বিটুমিন নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের প্রকল্পের স্থানে পৌঁছানোর জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। বিভিন্ন মাধ্যমে জনশ্রুতি রয়েছে যে, ঠিকাদারের প্রতিনিধিরা কো¤পানির কাছ থেকে নেওয়া বিটুমিন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের স্থানে প্রেরণ না করে উচ্চমূল্যে অন্যদের কাছে বিক্রি করেন।