টানেলের কারণে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার টানেল ব্যবহার করে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে আনা-নেওয়া করা যাবে দ্রুত সময়ে।
চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে যোগাযোগ-সুবিধার কারণে শিল্পকারখানার কাঁচামাল যেমন সহজে আনা-নেওয়া করা যাবে, তেমনি প্রস্তুত পণ্যও সারা দেশে খুব সহজে নেওয়া যাবে টানেলের মাধ্যমে। টানেলের কারণে শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃত হবে না, একই সঙ্গে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটবে।
টানেল চালু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ। যা দেশের অর্থনীতিতে গতি বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্ণফুলী নদীর ওপারে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইপিজেড, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বাড়বে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। সাশ্রয় হবে অর্থ ও সময়ের। সর্বোপরি পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে টানেল। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নগর চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি টু টাউন। দুই পাড়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন হবে।
বিজিএমইএর চট্টগ্রামের প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে শিল্পোন্নয়নের আছে নিবিড় স¤পর্ক। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গপথ অর্থাৎ টানেল সেই সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন নতুন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। টানেলের কারণে যে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন বেশি। গতি বাড়বে আমদানি রপ্তানি প্রক্রিয়ায়। বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান, ঘুচবে বেকারত্ব।
প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, টানেলের নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সহজ ও আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, শিল্পকারখানার বিকাশ এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের ফলে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা বেকারত্ব দূর করাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া জিডিপিতেও রাখবে ইতিবাচক প্রভাব। টানেল চালু হলে শিল্পায়ন, পর্যটনশিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, টানেলের কারণে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এই টানেলের কারণে বাংলাদেশও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর থেকে সহজেই সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়া যাবে। টেকনাফ থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত শিল্পায়নের বিপ্লব ঘটবে। বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। টানেলের কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হবে।
মাহবুবুল আলম আরও বলেন, টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়ার পর থেকেই নতুন নতুন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। আবার পুরোনো কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে টানেলকে কেন্দ্র করে ই¯পাত, সিমেন্ট, খাদ্য, ফিশারিজ, টেক্সটাইল খাতের বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছে। অনেক উদ্যোক্তা কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে আগাম জমি কিনে রেখেছেন। অথচ এক দশক আগেও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে তেমন কোনো শিল্পকারখানা ছিল না।
তিনি আরও বলেন, টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজারে চারটি ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টানেলের সুফল পাবে আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান ইপিজেডও। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে এই সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে টানেলের মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হলে শুরুতে কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পায়ন হবে। তবে মিরসরাই থেকে টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ হলে বহুবিস্তৃত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল ও মিরসরাইয়ের প্রস্তাবিত বন্দর যুক্ত হয়ে সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠবে। এতে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাগর উপকূল ধরে মেরিন ড্রাইভের আশপাশের দীর্ঘ এলাকা দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প করিডরে রূপ নেবে।
ঈশান/মউ/জুঁই