চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে আগামি ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। এ নিয়ে প্রচারণায় রয়েছেন প্রার্থীরা। টাঙিয়েছেন ব্যানার-পোস্টার। কিন্তু প্রচারণার পোস্টার লেমিনেটেড করে লাগানো হয়েছে পলিথিন। যা পরিবেশের জন্য মারাত্নক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদি সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, চট্টগ্রাম-১০ আসনের জিইসি, ওয়াসা, লালখানবাজার, দুই নম্বর গেটসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমান সংসদ সদস্য এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর পোস্টার সাটানো হয়েছে। পোস্টারগুলো পলিথিন দিয়ে লেমিনেটিং করা।
একইভাবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সমঝোতার পর চট্টগ্রাম-৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীকে সরিয়ে নেয় দলটি। এই আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে লড়ছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। তার সাথে লড়াই করছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনে তিনি হেভিওয়েট প্রার্থী। এ আসনের প্রতিটি অলিগলিজুড়ে লাগানো হয়েছে তাঁর পোস্টারও। তবে এসব পোস্টার পলিথিন দিয়ে লেমিনেটিং করা। এই সংসদীয় আসনগুলো ছাড়াও অন্যান্য আসনের বেশিরভাগ প্রার্থী পোস্টারে ব্যবহার করেছেন লেমিনেটিং। অথচ পলিথিন মাটি, পানি, বায়ুকে সমানভাবে দূষিত করে। যা পরিবেশের জন্য ডেকে আনবে মারাত্নক বিপর্যয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনের পরে পোস্টারগুলো আমি নিজেই অপসারণ করে নেবো। আর সিটি করপোরেশনও সহায়তা করবে। আর এটা সহজেই নষ্ট করা যাবে। পরিবেশকে দূষণ করার কোনো সুযোগ নেই।
পলিথিন যেহেতু অপচনশীল সেহেতু কোন প্রক্রিয়ায় নষ্ট করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগুন জ্বালিয়ে দিলেই তো হয়ে গেলো। পলিথিন আগুনে পোড়ালে পরিবেশ দূষণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে তো উপায় নেই নষ্ট করার-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পরেরটা পরে দেখা যাবে বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
শুধু চট্টগ্রাম-৮ বা ১০ আসন নয়, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে গিয়েও দেখা মিলেছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের লেমিনেটিং করা পোস্টারের। শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) নগরীর আন্দরকিল্লা প্রিন্টিং প্রেসে গিয়ে দেখা যায়, এই প্রার্থীর লেমিনিটিং করা পোস্টারের ছাপাকাজ চলছে এখনো।
এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম-১০ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে চট্টগ্রাম-১১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন বলেন, মূলত কুয়াশার কারণে লেমিনেটিং করা হয়েছে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে পোস্টারে পলিথিনের ব্যবহারকে সমর্থন করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি গণসংযোগে আছি। আপনি আমার প্রচার সেলের সাথে যোগাযোগ করুন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রার্থী বলেন, মূলত আমাদের টাঙানো পোস্টারগুলো লেমিনেটিং করার কারণ বৃষ্টি ও কুয়াশা। আর এখন যেহেতু শীতের মৌসুম তাই পোস্টার নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে এর বিকল্প নেই। নষ্ট হয়ে গেলে আবারও ছাপাতে হবে এবং লাগাতে হবে। ফলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, সংসদীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এ নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বলা আছে প্রত্যেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তিকে বিধি ৬ হইতে বিধি ১৪ এর বিধানাবলী অনুসরণ করিতে হইবে। কিন্তু এসব বিধিমালার কোথাও পোস্টারে পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যবহারে বিধি-নিষেধের কথা উল্লেখ নেই।
নির্বাচন শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পরই নগরীতে টাঙানো প্রার্থীদের পোস্টারগুলো অপসারণে কাজ করবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। সংস্থাটি কি এসব পলিথিনের বর্জ্য রিসাইকেল করতে পারবে কিংবা বর্জ্যগুলো কোথায় ফেলা হবে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে যোগাযোগ করা হয় চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমীর সাথে।
তিনি বলেন, আমাদের রিসাইকেল প্লান্ট নেই। এক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী প্রার্থীদেরকেই পোস্টারগুলো অপসারণ করতে হবে। তারপরও আমরা এগুলো করপোরেশনের পক্ষ থেকে অপসারণ করি। কিন্তু রিসাইকেল করার সুযোগ নেই। পলিথিনের বর্জ্যও ডা¤িপং স্টেশনেই চলে যাবে। পলিথিন সোর্সটাই আমাদের বন্ধ করতে হবে। আর এটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, কয়েকদিন আগে এক জায়গায় ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে ১০ মিটারের মতো শুধু পলিথিন উঠে এসেছে মাটি থেকে। যাঁরা সেখানে কাজ করছিলেন তাঁরা আমাকে জানালেন সেখানে ময়লা কম, শুধু পলিথিন উঠে আসছে। পলিথিনগুলো পরিবেশেই থেকে যাচ্ছে। এখন আসলে উপায় নেই এগুলো নষ্ট করার।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতামত :
লেমিনেটেড পোস্টারের কারণে পরিবেশের মারাত্নক বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ স¤পাদক আলমগীর কবির। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আসলে আমরা উদ্বিগ্ন। এমনিতেই বাজার সয়লাব পলিথিনে। এর ওপর মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ জনপ্রতিনিধিদের এই লেমিনেটেড পোস্টার। যেটি আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য মারাত্নক হুমকি স্বরূপ। ভোটের পর পোস্টারগুলো রাস্তায় পড়ে থাকবে। এরপর সেগুলো ড্রেনে গিয়ে ড্রেনেজ সিস্টেমের বিপর্যয় ঘটাবে। আর অন্যান্য পরিবেশগত বা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতো আছেই। নগরীতে জলাশয়, নদী বা পুকুর না থাকায় পানিগুলো ঠিকমতো যেতে পারে না। আর এর একটি বড় কারণ হচ্ছে প্লাস্টিক বা পলিথিন।
নির্বাচন কমিশনকে তাগাদা দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ইসি এসব লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। কিন্তু এই পলিথিনের কারণে পরিবেশে কী কী ক্ষতি হয় তা আমরা চিঠির মাধ্যমে তাঁদের বুঝিয়ে বলবো। এরপরেও তাঁরা ব্যবস্থা না নিলে আমাদের উচ্চ আদালতে রিট করারও পরিকল্পনা রয়েছে। এখন একজন সংসদ সদস্য যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি তো এরকম পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাতে পারেন না।
একজন প্রার্থী আগুন দিয়ে লেমিনেটেড পোস্টার জ্বালিয়ে অপসারণ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে। সমুদ্রস¤পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রেও দায়ী পলিথিন। ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় লবণে এবং মাছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে।
নির্বাচনে পোস্টারের ব্যবহার কমিয়ে প্রার্থীদের ডিজিটালি প্রচারণার দিকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নির্বাচনে এখন অনেক প্রার্থী পোস্টারে লেমিনেটিং করেন। যা তাঁদের কাছ থেকে আমাদের কোনোভাবে কাম্য নয়। এরকম পোস্টার টাঙানোয় মানুষ কতটা আকৃষ্ট হয় এই ডিজিটাল যুগে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেহেতু এখন ডিজিটাল যুগ, তাই প্রচারটাও ডিজিটালি করা উচিত। কারণ প্লাস্টিক-পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্নক হুমকির কারণ।
জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনারা যাঁরা নির্বাচন করছেন, জনপ্রতিনিধি হবেন আপনারা মানুষকে ভালো রাখতেই জনপ্রতিনিধি হবেন। অতএব কিভাবে মানুষ ভাল থাকবে সেটাও আপনাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ।
নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যবহার করা লেমিনেটেড পোস্টারের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মেট্রো) মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, এ ব্যাপারে আমার জানা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু হয়। ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়।
ঈশান/মখ/সুপ