“আসবাবপত্র বা যন্ত্রপাতি— কোনোটিরই চাহিদা ছিল না। বিভাগীয় প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়েও কোনো চাহিদা পাওয়া যায়নি। শেষমেশ দুর্নীতিবাজ চক্রটি নিজেরাই তৈরি করে কৃত্রিম চাহিদা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে সে অনুযায়ী আসবাবপত্র ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য নিজেরাই আহ্বান করে দরপত্র। সেই দরপত্রে কাজও পায় নিজেদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই। পরে শুধু ব্যবহারের অনুপযোগী নন-ব্রান্ডের আসবাবপত্র সরবরাহের নামেই সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়। এর বাইরে আত্মসাতই করে ফেলা হয় দেড় কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির পথ সুগম করতে তৈরি করা হয় দুটি ভুয়া জিও বা সরকারি আদেশও”
প্রচলিত বাজারদরে আসবাবপত্রের প্রকৃত মূল্য ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অথচ সেই আসবাবপত্রের দাম দেখানো হয় ২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। দুই ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে এভাবে ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিমসহ তিনজন ডাক্তার। এর মধ্যে দেড় কোটি টাকা মেরেই দেওয়া হয়। এমনই অবিশ্বাস্য দুর্নীতির ঘটনা ঘটে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে।
এ ঘটনা প্রায় ৫ বছরের তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিমসহ তিন চিকিৎসক ও দুই ঠিকাদারসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা ও দেড় কোটি টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
দুর্নীতির এসব ঘটনায় জড়িতরা হলেন— কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক (বর্তমানে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজে কর্মরত) ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান। ঢাকার মগবাজার দিলু রোডের মেসার্স এস এল ট্রেডার্সের মালিক মিঞা সাদুল্লাহ বিন হাসান এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আফসানা ইসলাম কাকলী।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম আসবাবপত্রের প্রয়োজন না থাকা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের চাহিদাপত্র না থাকার পরও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনার উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭টি প্যাকেজের মাধ্যমে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের মালামাল কেনার জন্য তিনি ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই এমএসআর নির্বাচন ও স্পেসিফিকেশন, বাজারদর যাচাই, দরপত্র উন্মুক্তকরণ, দরপত্র মূল্যায়ন এবং সার্ভে কমিটিসহ মোট পাঁচটি কমিটি গঠন করেন।
অথচ এসব কমিটি গঠনের দুদিন আগেই কমিটিগুলো অনুমোদনের জন্য ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক বরাবরে চিঠি পাঠান। শেষমেশ ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর কমিটি গঠনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। তদন্তে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই অনুমোদনের আগেই কক্সবাজার মেডিকেলের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম তার প্রস্তাবিত কমিটির প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৮ জুলাই দরপত্র নির্বাচন ও স্পেসিফিকেশন কমিটি কর্তৃক স্পেসিফিকেশন নির্বাচন করে ফেলেন। একই বছরের ৮ আগস্ট বাজারদর সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান, কক্সবাজার জেলা মার্কেটিং অফিসার শাহজাহান আলী আসবাবপত্রের মূল্য ওই সময়ের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দেখিয়ে বাজারদর প্রতিবেদনও তৈরি করেন।
তদন্তে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ৭টি প্যাকেজে আসবাবপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। এর প্রেক্ষিতে প্যাকেজ-৫ (আসবাবপত্র) এর জন্য তিনটি দরপত্র দাখিল হয়। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ওই বছরের ২৯ আগস্ট তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন এবং তুলনামূলক বিবরণী প্রস্তুত করেন। নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ, এসএল ট্রেডার্স ও পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তিনটি দরপত্রই টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি গ্রহণ করে। তবে আইটেমভিত্তিক সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ও এসএল ট্রেডার্সকে নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে ২৩টি আইটেমের জন্য নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ এবং টেন্ডারে বর্ণিত ৩৯টি আইটেমের জন্য এসএল ট্রেডার্সকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
পরবর্তীতে অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর মালামাল ক্রয় সংক্রান্ত দরপত্রগুলোর মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক বরাবরে আবার চিঠি পাঠান। কিন্তু সেই অনুমোদনের আগেই অধ্যক্ষ ডা. রেজাউল করিম এসএল ট্রেডার্সকে ৭টি কার্যাদেশের মাধ্যমে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ টাকার আসবাবপত্র সরবরাহ করার কার্যাদেশ দিয়ে দেন। একইভাবে নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজকেও দুটি কার্যাদেশের মাধ্যমে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার ৩৫০ টাকার আসবাবপত্র সরবরাহ করার কার্যাদেশ দেন তিনি।
২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এসএল ট্রেডার্স ৭টি কার্যাদেশের মাধ্যমে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ৩১ আইটেমের আসবাবপত্র সরবরাহ করে। এসএল ট্রেডার্স ওই ৩১ আইটেমের মধ্যে ২২ ধরনের ফার্নিচার একাধিক কার্যাদেশের মাধ্যমে এবং ৯৫০টি এক্সিকিউটিভ চেয়ার পাঁচটি কার্যাদেশের মাধ্যমে সরবরাহ করে। কিন্তু এসএল ট্রেডার্সের সরবরাহ করা আসবাবপত্রের কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি।
এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পর কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে কেনা ফার্নিচারের গুণগতমান যাচাই ও ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার জন্য ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর অনুরোধে গণপূর্ত বিভাগ চট্টগ্রাম জোনের পক্ষ থেকে চারজন প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে এই টিমের সঙ্গে ঢাকা গণপূর্তের একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীকেও (ই/এম) যুক্ত করা হয়। বিশেষজ্ঞ টিমটি ২০১৯ সালের ৪ মার্চ থেকে চারদিন ধরে কেনা আসবাবপত্রগুলো যাচাই ও পরিমাপ গ্রহণ করে। এরপর ওই বছরের ১১ এপ্রিলে তাদের দেওয়া আসবাবপত্র যাচাই ও পরিমাপ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে এসএল ট্রেডার্স কর্তৃক সরবরাহকৃত ফার্নিচারের মূল্য প্রকৃতপক্ষে ৭ কোটি ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ১১৩ টাকা মাত্র। অথচ সরবরাহকৃত ফার্নিচারের মূল্য দেখানো হয়েছিল ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ টাকা। এ হিসেবে অতিরিক্ত টাকা দেখিয়ে আত্মসাতের চেষ্টা করা হয় ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ টাকা।
এছাড়া এসএল ট্রেডার্সের সরবরাহ করা ফার্নিচারের মধ্যে টেন্ডারে বর্ণিত আটটি আইটেমের আসবাবপত্র বিশেষজ্ঞ টিম কর্তৃক যাচাইকালে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। সরবরাহকৃত সকল ফার্নিচার নন-ব্র্যান্ডের মর্মে বিশেষজ্ঞ টিম তাদের পরিমাপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। অথচ এসএল ট্রেডার্স কর্তৃক দাখিলকৃত দরপত্রে ম্যানুফেকচারার কোম্পানি হিসেবে পারটেক্স ব্রান্ডের প্রত্যয়ন ছিল এবং ফার্নিচার যে কোনো স্বনামধন্য ব্রান্ডের দেওয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু ঠিকাদার পারটেক্স বা অন্য কোন স্বনামধন্য ব্রান্ডের মালামাল সরবরাহ না করে প্রতারণামূলকভাবে নিম্নমানের নন-ব্র্যান্ডের মালামাল সরবরাহ করে।
এ ঘটনায় ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর আসবাবপত্র সরবরাহের নামে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা ও দেড় কোটি টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিমসহ তিন চিকিৎসক ও দুই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই মামলা দুটি দায়ের করেন।
এর মধ্যে এক মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্রের চাহিদা না থাকার পরও প্রতারণার মাধ্যমে নিম্নমানের আসবাবপত্র বাজারদরের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কিনে সরবরাহ করেন। ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ১ কোটি ৫৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৯ টাকা আত্মসাত করেন তারা এবং আরও ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও প্রয়োজন না থাকার পরও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ থেকে ৭৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৫ টাকার আসবাবপত্র কিনে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন আসামিরা।
এই মামলায় আসামি করা হয় চট্টগ্রামের জামালখান রোডের সানমার ম্যাগনোলিয়া ভবনের বাসিন্দা (বর্তমান ঠিকানা) ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক (বর্তমানে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজে কর্মরত) ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) ও লোহাগাড়ার উত্তর কলাউজানের বাসিন্দা ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান, কক্সবাজার জেলা মার্কেটিং অফিসার শাহজাহান আলী এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আফসানা ইসলাম কাকলীকে।
অন্যদিকে অপর মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুইটি ভুয়া জিও সৃষ্টি করে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের আসবাবপত্র উচ্চ মূল্যে সরবরাহ করে ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ টাকা সরকারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিসাধন ও আত্মসাতের প্রচেষ্টা করার অভিযোগ আনা হয়।
দ্বিতীয় এই মামলার আসামিরা হলেন— কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ও বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান, জেলা মার্কেটিং অফিসার শাহজাহান আলী ও ঢাকার মগবাজার দিলু রোডের মেসার্স এস এল ট্রেডার্সের মালিক ফরিদপুরের বোয়ালমারীর বাসিন্দা মিঞা সাদুল্লাহ বিন হাসান।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঘটা আত্মসাতের ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪১/৫১১/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
ঈশান/মখ/মউ