দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সুশৃঙ্খল সামাজিক জীবন নিশ্চিতকরণ এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান পুলিশ বাহিনীর মৌলিক দায়িত্ব। এই ভূমিকা পালনে পুলিশ ফাঁড়ি-থানা মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে। পাশাপাশি রয়েছে পুলিশের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন। তবে বাস্তবতা হলো এসব সেবা প্রদানে এবং মানুষের আস্থা অর্জনে পুলিশ আশানুরূপ সফলতা দেখাতে বরাবরই ব্যর্থ ছিল।
এরই ক্রমধারায় ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট-২০২৪ সময়টিতে জাতি দেখল পুুলিশ বাহিনীর নির্মম আরেকটি রূপ। এই দিনগুলোতে রাজনৈতিক দলীয় মদদে পুলিশ নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ঝরে পড়ে কয়েকশ ছাত্র-জনতার প্রাণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে এখন সময় এসেছে পুলিশ বাহিনী সংস্কারের। আশার কথা, নতুন আইজিপি এ বিষয়ে স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে কথা বলেছেন।
তিনি সংস্কার প্রসঙ্গে পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তন, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি এবং জবাবদিহিমূলক সেবার কথাও বলেছেন। একইসঙ্গে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্যাতন, দুর্নীতি ইত্যাদি সংস্কারের বিষয়েও কথা বলেছেন।
প্রাসঙ্গিক, পুলিশের কাজে আধুনিকতার সংশ্লেষ, জনগণের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি জোড় দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান অভাব-অভিযোগকে মূল্যায়নপূর্বক সমাধানের আলোচনা করেছেন।
তবে এ বিষয়ে সাধারণ জনগণ মনে করে, বিগত ১৫ বছরে পুলিশ বাহিনীর মাঝে যে দলীয় নিয়োগ হয়েছে সেখানে শুধু পোশাক ও লোগো পরিবর্তনে সংস্কার হবে না। বর্তমান স্থিত জনবলের মাধ্যমে সংস্কার কাজ ব্যর্থ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রাখে, রাজনৈতিক এবং দলীয় সুবিধাপ্রাপ্তদের বাহিনীতে বহাল রেখে সংস্কারের আশা করাটা হবে এক ধরনের প্রহসন। সাধারণের ভাষ্য প্রথমে একান্ত দলীয় পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অমানবিক আচরণে অভ্যস্ত সদস্যদের অতিদ্রুত বাহিনী থেকে অব্যাহতি প্রয়োজন।
মনে হতে পারে, সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি বড় জনবলের শূন্যতা তৈরি হবে। এমনটা হতেই পারে। তবে আশার কথা হলো, পুলিশের কর্মবিরতিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা দেখিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতা। এই তরুণ-তরুণীরা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু মেধা, সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের শক্তি থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন এলাকায় টহল প্রদান করে দেশকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, আনসার বিদ্রোহের অপতৎপরতাকেও এরা নস্যাৎ করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রস্তাবনা হতে পারে; বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া যুবশক্তিকে পুলিশ বাহিনী সংস্কারে অংশীভূত করা যায় কিনা। এদের মধ্য থেকে আগ্রহীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে এবং যথাযথ চাকরিবিধি অনুসরণপূর্বক পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
স্বল্প সময়ের মাঝে এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এই নিয়োগ (বিশেষ করে নন ক্যাডার মিড লেভেলে এন্ট্রি যেমন এসআই পদবিতে) প্রক্রিয়া নৈতিকভাবে দুর্বল পুলিশ বাহিনীর মাঝে নতুন করে কর্মস্পৃহার সঞ্চার করবে। এই তরুণদের অন্তর্ভুক্তি পুরাতনদের বহু চর্চিত দলবাজি, দুর্নীতি ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।
জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গঠনে আরও একটি প্রস্তাবনা হতে পারে; প্রতিটি থানা-ফাঁড়ি বা অন্যান্য পুলিশ সংগঠনের সঙ্গে নাগরিক সমাজের সংশ্লিষ্টতা। এক্ষেত্রে নাগরিক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রজনতার অন্তর্ভুক্তি আবশ্যিক করা। এসব Watch Dog কমিটির মাধ্যমে প্রতিটি পুলিশ প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হতে পারে। এর মধ্যদিয়ে বেকারত্বের হ্রাস ঘটবে এবং পুলিশের মাঝে দেশপ্রেমিক, নিরপেক্ষ তরুণ প্রাণের সঞ্চার হবে। দেশ পাবে বন্ধুপুলিশ, জনগণের পুলিশ।
সাধারণ ও সচেতন নাগরিকের প্রত্যাশা্, পুলিশ হবে জনবান্ধব, বর্তমানে রাষ্ট্র বলতে যে পুলিশ বুঝায়-এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশ যেহেতু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভোগী, সেহেতু জনসেবাই মুখ্য হতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ নিরপরাধ মানুষ তো দুরের কথা, সাধারণ অপরাধি হিসেবে চিহ্নিত অভিযুক্তকেও কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া লাগানোর মতো অসম্মান থেকে বিরত থাকতে হবে।
পুলিশের আচরণ হবে মানবিক এবং সাবলীল। তবে হত্যাকান্ডের মতো সামাজিক শান্তি বিনষ্টকারী বড় অপরাধির বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নিবে। এক কথায় পুলিশের নীতি দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালনে পুলিশকে অবতীর্ণ হতে হবে।
লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এনডিসি, পিএসসি (এলপিআর)