বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

সাগরে ফেটে গেছে পাইপলাইন

তেল খালাসের শুরুতেই হোঁচট খেল বিপিসি!

blank
print news

কক্সবাজারের মহেশখালী উপকূলের গভীর সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে নির্মিত পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) খালাস প্রক্রিয়ার শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বহুল আলোচিত পাইপলাইন ফেটে যাওয়ায় তেল খালাস প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে এখন।

শনিবার (৮ জুলাই) দুপুরে এই তথ্য নিশ্চিত করেন বিপিসি নিয়ন্ত্রাণাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান। তিনি বলেন, দেশে প্রথমবারের নির্মিত কক্সবাজারের মহেশখালী উপকূলের গভীর সমুদ্রে স্থাপিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গত ৩ জুলাই সোমবার সকাল সোয়া ১০টায় সরাসরি জাহাজ থেকে তেল খালাস শুরু হয়। কিন্তু বুধবার বিকেল ৩টার দিকে পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে বহুল প্রতীক্ষিত এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যা পুনরায় চালু করা আর সম্ভব হয়নি।

এই কর্মকর্তা বলেন, পাইপলাইন ঠিক করতে কত সময় লাগবে তাও নিশ্চিত নয় এখনো। পাইপলাইনে তেল খালাস প্রক্রিয়াটি যেহেতু পরীক্ষামূলক ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকল্পটি আমরা এখনো বুঝে নিইনি। যে কারণে ত্রুটি সেরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি আমাদের বুঝিয়ে দেবে।

লোকমান বলেন, পাইপলাইনে জাহাজ থেকে ৭-৮ হাজার টনের মতো তেল খালাস হয়। জাহাজ থেকে বাকি তেল আগের পদ্ধতিতে শিপিং করপোরেশনের লাইটার ট্যাঙ্কারে করে পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া হবে।

বিপিসির বিপণন কর্মকর্তা মোরশেদ হোসেন বলেন, জাহাজ থেকে খালাস হওয়া তেলের চাপে ফুটো হয়ে যায় পাইপলাইন। পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে এমনটাই হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাইপলাইন ফেটে বেশ কিছু তেল সাগরেও মিশেছে। যে কারণে তড়িগড়ি করে তেল খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিপিসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জাহাজ এমটি হোরে ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) নিয়ে সৌদি আরব থেকে ২৪ জুন মাতাবাড়িতে পৌঁছে। বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারটি ২২৯ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের। ২৫ জুন তেল খালাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৮ জুন পর্যন্ত কমিশনিং কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

এরপর গত ২ জুলাই রোববার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় দফায় কমিশনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরদিন সোমবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে মাদার ভেসেল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাস শুরু হয়। যা ৩০ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু পাইপলাইন ফেটে গিয়ে তেল খালাস প্রক্রিয়ার শুরুতে হোঁচট খেল বিপিসি।

বিপিসি সূত্র আরও জানায়, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে এসপিএম স্থাপন করা হয়। যেখান থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দুটি আলাদা পাইপলাইন দিয়ে তেল প্রথমে নিয়ে আসার কথা কালারমারছড়ায় সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাঙ্ক ফার্মে। সেখান থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে।

এসব পাইপলাইনে ২০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল থাকবে এক লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন হবে ডিজেল বা পরিশোধিত তেল। এর মানে হচ্ছে এই পাইপলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে তেলের সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেড়েছে। বর্তমানে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঁচ লাখ টন সংরক্ষণ ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল সংরক্ষণ ক্ষমতা দুই লাখ ২৫ হাজার টন। বাকিটা পরিশোধিত তেল রাখার স্টোরেজ।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

ইআরএলের তথ্যমতে, বর্তমানে পরিশোধিত (রিফাইন্ড) এবং অপরিশোধিত (ক্রুড অয়েল) মিলে বছরে ৬০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর পুরোটা আনা হয় সাগরপথে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা জ্বালানি তেলবাহী বড় বড় অয়েল ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নিত। ওখান থেকে লাইটার ট্যাংকারে করে তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিপিসির কোটি কোটি টাকা খরচ হতো এবং দীর্ঘ সময় লাগত। লাইটারেজ করার সময় নানা কারণে অপচয়সহ বিপুল পরিমাণ তেল চুরি হতো। জ্বালানি তেল খালাসের মান্দাতার আমলের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বিশেষ করে মাদার ভ্যাসেল বসিয়ে রাখা এবং বিএসসির দুটি জাহাজ দিয়ে তেল লাইটারিং করতে বিপিসির বছরে খরচ হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

এই পরিস্থিতিতে দ্রুত জ্বালানি তেল খালাস, খালাসে সময় হ্রাস ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এসপিএম উইথ ডাবল পাইপলাইন নির্মাণ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতা এবং প্রতিকূলতায় তা হয়নি। পরে প্রকল্পের মেয়াদ তিন বার বাড়ানো হয়। একই সাথে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়ও। বর্তমানে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ১২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিটুজি চুক্তির আওতায় চার হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন সরকার। বিপিসি দিয়েছে এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ৬০১ কোটি টাকা। তবে বর্তমানে ডলারের দাম বাড়ায় প্রকল্প ব্যয় আট হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে।

প্রকল্পের আওতায় এক সেট এসপিএম পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, দুই লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক, তিনটি ব্লক ভাল্ব স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। পাইপলাইনে তেল খালাস সম্পন্ন হতে ৩০ ঘণ্টা সময় লাগবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাস সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, মহেশখালীতে এসপিএম প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ। রোববার দিবাগত রাতে এসপিএম প্রকল্পে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল আনলোডের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এরই মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।

চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেল বড় জাহাজ থেকে লাইটারে, সেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পৌঁছায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে। এতে এক লাখ টনের তেলবাহী জাহাজ খালাস করতে সময় লাগে ১১ দিন। যা এসপিএমে লাগবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জট কমবে, পরিবহন ব্যয়ে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। কমবে সিস্টেম লস। সেইসাথে বাড়বে বাংলাদেশের তেল মজুদ ক্ষমতা।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। এর দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৩০ লাখ বেড়ে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, এসপিএম প্রকল্পটি ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে। ফলে জ্বালানির তেলের মজুদ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং জোগানের নিরাপত্তা বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page