চট্টগ্রামে এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানার পুড়ে যাওয়া চিনির বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এতে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়া।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এস আলম সুগার মিলের নালা দিয়ে পোড়া বর্জ্য আসছে কর্ণফুলী নদীতে। এতে নদীর পানি তামাটে রং ধারণ করেছে। নদীর তীরে মাছ কুড়াচ্ছে শত শত মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, নদীতে ফেলা কেমিক্যাল বর্জ্য কর্ণফুলী নদীর প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে নদীর পানির রং পরিবর্তনের পাশাপাশি মারা যাচ্ছে মাছ, চিংড়ি-কাঁকড়াসহ নানান জলজ প্রাণী।
শুধু কর্ণফুলী নদীতেই ফেলা হচ্ছে না, চিনির পোড়া বর্জ্য কারখানার আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।
মাছ ধরতে আসা জড়িত স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে কারখানার বর্জ্য নিয়মিতই নদীতে ফেলা হয়। এরপর নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে। তবে বর্জ্য এখন রাস্তাঘাট ও জমিতে ফেলছে। এতে আমাদের পরিবার ও স্বজনরা অসুস্থ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাহেদুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সকালে নদীতে মাছ ভেসে আসার খবরে এখানে এসেছি। এখানে কেউ জাল দিয়ে আবার কেউ হাতেই মাছ ধরছে। চিনিকলের বর্জ্যে নদীর পানির রং নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক মাছ এরই মধ্যেই মারা গেছে। কিছু দুর্বল হয়ে জালে আসছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, সুগার মিলের পোড়া চিনি কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে এমন তথ্য পেয়ে বুধবার আমাদের ল্যাব থেকে লোকজন গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ল্যাবের রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি স¤পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র মারা যাচ্ছে বা দুর্বল হয়ে পড়ছে। অবশ্যই এটি নদীর জন্য ক্ষতিকর।
কর্ণফুলী উপজেলা মৎস্য অফিসার স্বপন চন্দ্র দে বলেন, আমি যা দেখেছি অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মাছগুলো মারা যাচ্ছে। মাছ গুলো খাওয়া যাবে কিনা এ মূহুর্তে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিনির দাহ্য পদার্থ যখন ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে তখন বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নেয়। আর সেখানে পানি ছাড়া হলে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন কার্বন তৈরি হয়। যে কারণে কারখানায় পোড়া চিনি বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নিয়ে নদী দূষণ করছে। যার কারণে নদীর মাছসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানার জন্য এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি বুধবার কোনও সংবাদকর্মীকে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটের সামনে দায়িত্বরত কর্মচারীরা জানান, কর্মকর্তারা বলে দিয়েছেন যাতে কোনও সাংবাদিক ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় পুড়ে যাওয়া চিনি নালার মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছিল। এখন আমরা ট্রাকে জমিতে পুঁতে ফেলছি।
এস আলম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) আকতার হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, আগুনে পোড়া চিনি কর্ণফুলীতে যাচ্ছে না। এসব নিজস্ব জমিতে ডা¤িপং করা হচ্ছে। আর নদীতে গেলেও তা নদী কিংবা জীববৈচিত্রের কোনও ক্ষতি হবে না। কেননা, এখানে কোনও ক্ষতিকারক রাসায়নিক নেই।
এস আলম গ্রুপের মানবস¤পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বলেন, সোমবার বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে নগরীর কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্যারটেক ইছাপুর এলাকায় অবস্থিত ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। গুদামটিতে এক লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি ছিল। যার সবটুকুই পুড়ে গেছে। যার বাজারমূল্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এখনও আগুন জ্বলছে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, আগুন এখনও জ্বলছে। হয়তো নিভতে আরও সময় লাগবে। যেখানে আগুন লেগেছে সেটিতে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত ছিল। এগুলো এক ধরনের দাহ্য পদার্থ। পানি দিয়েও এ আগুন নেভানো যাচ্ছে না। এ কারণে আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। তবে আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কবে নাগাদ আগুন নেভানো যাবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট আগুন নির্বাপণে কাজ করছে। গুদামটির চারপাশ থেকে পানি দেওয়া হচ্ছে। গুদামটির টিন খুলে ফেলা হচ্ছে।
এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমান বলেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলার কারণে মাছ মারা যাচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, তদন্ত পরবর্তীসময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী বলেন, শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত ছিল। তারা ডা¤িপংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখেনি। এ কারণে কারখানা থেকে পোড়া বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। এতে নদীর পানি দূষিত হবে। ক্ষতি হবে মৎস্যস¤পদ এবং জীববৈচিত্র। এস আলম গ্রুপ হয়তো পুড়ে যাওয়া স¤পদের ক্ষতি একসময় পোষাতে পারবে। পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা আর পূরণ হবে না। এ জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সজাগ হতে হবে।
হালদা নদী গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, পুড়ে যাওয়া চিনি নদীতে পড়লে অবশ্যই নদীর ক্ষতি হবে। চিনি হোক আর যা হোক এগুলো এক্সট্রা কেমিক্যাল। এগুলো পানির কোয়ালিটি নষ্ট করবে। এতে পানিতে অক্সিজেনের শূন্যতা সৃষ্টি হবে। এ কারণে পানিতে থাকা জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই এসব যাতে নদীতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে জোয়ার-ভাটার কারণে এই সমস্যা একসময় পূরণ হবে। তাও সময় সাপেক্ষ।
ঈশান/খম/সুম