চার কোটি ৬৩ লাখ টাকার করোনা সুরক্ষাসামগ্রী বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে কেনার অভিযোগে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ রেলের তৎকালীন জিএম (পূর্ব) সরদার সাহাদাত আলীসহ ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল।
কিন্তু শাস্তি তো দূরের কথা, সুপারিশ উপেক্ষা করে সরদার সাহাদাত আলীকে জিএম থেকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক করার পর এবার আরও এক দফা পদোন্নতি দিয়ে করা হচ্ছে মহাপরিচালক (ডিজি)। ইতিমধ্যে এই পদে তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পরও শাস্তি না দিয়ে দফায় দফায় পদোন্নতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, শাস্তির পরিবর্তে পদোন্নতির ঘটনা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করবে। এতে সৎ কর্মকর্তারা মনোবল হারিয়ে ফেলবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) এবং বর্তমানে মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অনেক ত্রুটি ছিল। সব কেনাকাটা নিয়ম মেনেই করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, করোনাসামগ্রী কেনার সময় তিনি জিএম হিসেবে মাত্র ৬ মাস দায়িত্বে ছিলেন। বাজার যাচাই কমিটি যাচাই করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর তিনি তা অনুমোদন করেছিলেন। অথচ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির একজনকে অভিযুক্ত করা হলেও ২ জনের নাম ছিল না তদন্ত প্রতিবেদনে। এমনকি তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন না সেই সময়ের কেনাকাটার দায়ও তার ওপর দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু পুরো বিষয়টি তিনি মন্ত্রণালয়কে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর মন্ত্রণালয় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তাই অভিযোগের বিষয়টি আগেই মন্ত্রণালয় থেকে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
অথচ এ ঘটনার পর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে বদলি হন সরদার সাহাদাত আলী। ওই সময় গণমাধ্যমকর্মীরা করোনাসামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, রেলওয়েতে সৎ মানুষ কে আছে? এখানে কোন ভাল মানুষ নাই। এই মন্তব্যে তখন তোলপাড় সৃষ্টি হয় রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মাঝে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই কোভিড-১৯ প্রতিরোধমূলক সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধার বিনিময়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে কেনার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়।
যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকিকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, করোনা মোকাবিলায় সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় অনিয়ম হয়েছে এবং কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। এমনকি দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই অনেক জিনিস কেনা হয়েছে। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
একইসঙ্গে ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় তাদের না রাখার সুপারিশও করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন ঠিকাদারের কাছ থেকে চার কোটি ৬৫ লাখ টাকার জিনিসপত্র কেনা হয়েছে। চাহিদাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বানের আগেই সরবরাহকারীদের কাছ থেকে মালপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাজারদর যাচাইকারীদের বাজারদরে অর্থাৎ প্রতিটি জিনিসের অধিক একক মূল্য দেখেও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন স¤পর্কে মন্তব্য বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করা যৌক্তিক মর্মে বিবেচিত হয় না।
এই কেনাকাটা যখন হয়েছিল তখন সরদার সাহাদাত আলী রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনিসহ তিনজন বাজারদরের চেয়ে অধিক দরে কেনাকাটার প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করেন। যেমন বাংলাদেশ রেলওয়ের সরঞ্জাম বিভাগের তিনটি ক্রয় ইউনিট একই জিনিস ভিন্ন দামে কিনেছে।
উদাহরণস্বরূপ কেএন-৯৫ মাস্ক সিসিএস অফিস কিনেছে প্রতিটি ৭২৭ টাকা দরে, সিওএস (পূর্ব) অফিস কিনেছে ৩৫১ টাকা দরে ও সিএমই (পূর্ব) অফিস কিনেছে ২৫০ টাকা দরে। একইভাবে এক লিটার বোতলের স্যাভলন সিসিএস অফিস কিনেছে প্রতিটি ৪৪২ টাকা দরে, সিওএস (পূর্ব) অফিস কিনেছে ৬৪৭ টাকা দরে ও সিএমই (পূর্ব) অফিস কিনেছে ৭৫০ টাকা দরে।
প্রায় ১৭০০ পৃষ্ঠার এ রিপোর্টে উঠে আসে রেলের কেনাকাটায় ৫টি জীবাণুনাশক টানেল ৬২ লাখ টাকায় কেনা হয়। মডার্ন প্রাইম কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান দুটি স্ক্যানার চুক্তির আগেই সরবরাহ করে। এছাড়া করোনাসামগ্রীর একই পণ্য ভিন্ন ভিন্ন দামে কেনা হয়। কেএন-৯৫ মাস্ক এক জায়গায় কেনা হয় ৫৮৬ টাকায়, অন্য জায়গায় কেনা হয় ৭২৭ টাকায়। ৭৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকার থার্মোমিটার ১২ হাজার ৩০০ টাকা, ৮ টাকার গ্লাভস ৩২ টাকায়, ১০ টাকার মিনি সাবান ২৫ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ডিটারজেন্ট ১৮৮ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ব্লিচিং পাউডার ১৯৩ টাকায়, ১৩০ টাকার হেক্সাসল ৩৮৪ টাকায়, ১২০ টাকার প্লাস্টিক চশমা ৩৯৭ টাকায়, ১৫০ থেকে ৪০০ টাকার চীনের তৈরি কেএন-৯৫ মাস্ক ৭২৭ টাকায় এবং ট্রলি ও ফ্লুমিটারসহ প্রতিটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয়েছিল ৪১ হাজার টাকায়।
তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো এবং প্রতিযোগিতামূলক দর পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে তা না করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, তদন্তে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো সরদার সাহাদাত আলীকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। আর গত ১২ মার্চ তাকে মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন চলছে স্থায়ীভাবে মহাপরিচালক করার চেষ্টা।
সূত্র জানায়, রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) বর্তমানে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী তার বন্ধু বাবলুর মাধ্যমে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ ও টেন্ডার বাণিজ্য করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে তার বন্ধু বাবলু রেলের কোনো কেনাকাটা বা কাজের সঙ্গে যুক্ত নন বলে জানান সরদার সাহাদাত আলী।