কর্মব্যস্ত নগরজীবনে ঈদের ছুটি নিয়ে এসেছে অবকাশের ফুরসত। তার সাথে যোগ হয়েছে নববর্ষের ছুটিও। দুই উৎসবের লম্বা ছুটি উপভোগ করতে কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটছেন নগরীর বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে।
ঈদের দিন বিকেল থেকে শনিবার (১৩ এপ্রিল) পর্যন্ত নগরীর সবকটি বিনোদনকেন্দ্র ছিল লোকে লোকারণ্য। বিশেষ করে নগরীর পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকত, সিআরবি শিরীষতলা, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী শিশু পার্ক, বহদ্দারহাট স্বাধীনতা কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ফয়স লেক, ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড, প্রজাপতি পার্ক, কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাটসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে বেড়েছে মানুষের ভিড়।
খাড়া রোদে তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করে সকাল থেকেই মানুষ ছুটছেন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। নিজেদের আনন্দের মুহূর্তটি ক্যামেরায় ধরে রাখতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তারা।
শনিবার সকাল নয়টায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার প্রধান ফটকে দেখা যায় দর্শনার্থীর ভিড়। ৭০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে টিকেট হাতে চিড়িয়াখানায় ঢুকছেন তারা। চিড়িয়াখানা খোলা সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভিড় বাড়তে থাকে। এর মধ্যে বাবার হাত ধরে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করে চার বছর বয়সী তানজীর।
তার বাবা সাকের রফিক বলেন, ‘বাচ্চারা ছোট তাই বইয়ের পাশাপাশি নানা রকম পশু পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ঈদের ছুটিতে চিড়িয়াখানায় নিয়ে এসেছি। বাচ্চারা বাঘ দেখে প্রশ্ন করে, বাঘ এমন কেন? পাখি এমন কেন? ওরা কী খায়? আরও নানা প্রশ্ন তাদের। তাদের আনন্দ দেখে আমাদেরও ভালো লাগছে।’
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, সকাল থেকে দর্শনার্থী আসছে। তবে দুপুর ৩টার পর ভিড় বাড়তে শুরু করে। শুক্র ও শনিবার প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজারের মতো দর্শনার্থী এসেছেন চিড়িয়াখানায়। ঈদ ও নববর্ষের ছুটি থাকায় দর্শনার্থী আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের চিড়িয়াখানায় দুর্লভ সাদা বাঘ, সিংহ, বানর, হনুমান, জেব্রা ও বিভিন্ন প্রজাতির হরিণসহ অসংখ্য সাড়ে পাঁচশ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে। এখানে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে আসেন বয়স্করাও। চিড়িয়াখানার পশুপাখির পাশাপাশি পাহাড়ের মাঝখানে থাকা সিঁড়ি এবং শিশুদের রাইডগুলো বেশ উপভোগ্য।
ঈদ উৎসবে মেতে উঠেছে চিড়িয়াখানা সংলগ্ন চট্টগ্রামের ফয়েস লেকও। ঈদের দিন থেকে সেখানে উপচে পড়া ভিড় দর্শনার্থীদের। তরুণ-তরুণিদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আনন্দ হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে ফয়েস লেক কর্তৃপক্ষ।
কনকর্ড ফয়স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের ডেপুটি ম্যানেজার (মার্কেটিং) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, তরুণ তরুণিদের কাছে চট্টগ্রামের আনন্দ বিনোদনের সবচেয়ে আর্কষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় ওয়াটার পার্ক সি ওর্য়াল্ড। ঈদ ও নববর্ষের লম্বা ছুটি কাটাতে সঠিক গন্তব্য হতে পারে ফয়েস লেক রির্সোট ও বাংলো। ঈদ ও নববর্ষ ঘিরে বিভিন্ন রাইডসে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ ছাড়। ১০ দিন পর্যন্ত চলবে ডিজে শো। ঈদের দিন থেকে এখানে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় জমছে।
কর্তৃপক্ষের মতে, ফয়েস লেক ভ্রমণে নগরবাসী পায় অনন্দের পরিপূর্ণতা। কারণ এখানে রয়েছে বিনোদনের সকল উপকরণ আর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখানে সব বয়সি মানুষের আনন্দ বিনোদনের জন্য রযেছে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ওয়াটার পার্ক সি-ওয়ার্ল্ড, ফয়েস লেক রিসোর্ট, বেস ক্যা¤পসহ নানারকম আয়োজন।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ৩৩৬ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র ফয়েস লেক কমপ্লেক্স। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় পাঁচ কিলামিটার জুড়ে আঁকাবাকা সৌন্দর্যমন্ডিত লেক। নগরের জিরো পয়েন্ট জিইসি থেকে তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর মূল সড়কের একটু পাশেই বিশাল এক তোরণ, আর এই তোরণ পাড় করে ভেতরে প্রবেশ করলেই অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। এই পার্ক সাজানো হয়েছে অনেকগুলো রাইড নিয়ে।
উল্লেখযোগ্য রাইডগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্কাস সুইং, বা¤পার কার, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, ফেরিস হুইল, পাইরেট শিপ, কফিকাপ, রেড ড্রাই-স্লাইড, ইয়োলো ড্রাই-স্লাইড, বাগ বইন্স ইত্যাদি খাবার-দাবারের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট যেখানে পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি নানা রকম খাবার অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ঠিক পাশেই দেখা মিলবে হরেক রকম মাছের খেলা। অ্যামিউজমেন্ট পার্কের সিড়ি ভেঙ্গে উপড়ে উঠলেই দেখা মিলবে ফয়েস লেকের।
লেকের দু-পাশে শুধু যেন সবুজের ছোয়া আর দিগন্ত জুড়ে নীল আকাশ জীববৈচিত্রে ভরপুর, সারি সারি পাহাড় আর হরেক রকম গাছ-গাছালি। এখানকার বিভিন্ন পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে অরুণিমা, জলটুঙ্গি, গোধুলি, অস্তাচল, আকাশমণি, বনশ্রী, হিমঝুরি, আসমানি, গগণদ্বীপ, উদয়ণ প্রভৃতি নামে।
পাহাড়ের ঠিক উপড়েই আছে ফটো কর্ণার। যেখানে দেখা মিলবে নানা ভঙ্গিতে হরেক রকম প্রাণীর ভাস্কর্য। লেকের গা-ঘেঁষেই তৈরি করা হয়েছে সমুদ্রিক প্রাণীদের ভাস্কর্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পিকনিক ¯পট অ্যাকুয়াটিক জোন।
ফয়েস লেকের বোট স্টেশন থেকে ইঞ্জিন বোটে দশ মিনিটের পথ পেরোলেই দেখা মিলবে দেশের সর্ববৃহৎ ওয়াটার পার্ক সি-ওর্য়াল্ড। একপ্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে জলের রাজ্যে এক রোমাঞ্চকর এই পার্ক। দিনভর সকলকে নিয়ে জলকেলি উৎসবে মেতে উঠার জন্য রোমাঞ্চকর সব রাইডে গড়ে তোলা হয়েছে এ জায়গাটি। এখানকার সবচেয়ে আর্কষণীয় স্থান কৃত্রিম সমুদ্র সৈকত যা ওয়েভ-পুল নামে পরিচিত। সাগরের ঢেউয়ের মতোই উচু উচু ঢেউ খেলা করে এখানে। টিউবে বসে ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো যায় ইচ্ছেমতো, ডুবে যাওয়ার ভয় থাকেন না একদম।
ওয়েভ-পুলের ঠিক পাশেই রয়েছে ড্যান্সিং জোন যেখানে কৃত্রিম বৃষ্টি, নানা রঙ্গের আলো আর মনমাতানো মিউজিক তালে তালে নেয়ে উঠে আগত দর্শনার্থীরা। চিলড্রেন পুলটি সাজানো বাচ্চাদের উপযোগী অনেকগুলো রাইড নিয়ে যা দিয়ে অনায়াসে উপভোগ করতে পারে তাদের জন্য গড়ে তোলা এ স্বপ্ন রাজ্যটি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজা করার জন্য আছে ফ্যামিলি পুল। সামান্য উচু থেকে নিচের দিকে খুব দ্রুত নিচের দিকে পানির নিচে পড়ে মজা পায় দর্শনার্থীরা। বেশ উচু জায়গা থেকে আঁকাবাকা পথ পেরিয়ে পুলে ধপাস করে পড়ার মজা পাওয়া যাবে এখানকার স্লাইড ওয়ার্ল্ডে। এছাড়াও মালি প্রাইড, ডোম স্লাইড, প্লে-জোনের মতো মজার মজার সব রাইড।
জানা যায়, ওয়াটার পার্ক সি-ওয়ার্ল্ড লাগোয়া রিসোর্টে রয়েছে শীততপ নিয়ন্ত্রিত পাহাড়মুখী ও হ্রদমুখী কক্ষ যেখান থেকে উপভোগ করা যাবে সবুজ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। নিরিবিলি পরিবেশে লেকের পাশেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলো। পর্যটকদের খাবার-দাবারের জন্য রয়েছে মানসম্পন্ন রেস্টুরেন্ট যা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে।
লেকের পাড় বেয়ে উপড়ে উঠলেই বেস ক্যা¤েপর মূল ফটক। আর এখানে ভেতরে প্রবেশ করে পাহাড়ি পথে সিড়ি পেরিয়ে জিপলাইনের কাঠামো এখান থেকেই তারে ঝুলে শূণ্যে ভেসে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা।
জিপলাইনের চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠলেই ট্রিটপ অ্যাডভেঞ্চার যেখানে ১০টি ধাপের নানারকম অ্যাডভেঞ্চারমূলক কার্যক্রম। বিভিন্ন ধাপের নিচে পাহাড়ি ঢল আর উপড়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যেতে হয় হবে কাঠের পাটাতন টায়ার, সরু ব্রিজ, মাকড়সার জালের মতো জাল ধরে চলাচল, বাকা-ত্যাড়া নানা নকশার ছোট ছোট সেতু। এরপর অবস্টেবল কোর্স যা বেস ক্যাম্পের অ্যাডভেঞ্চারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আরেক রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবে জায়ান্ট সুইং-এ। প্রকান্ড এক লৌহ কাঠামোতে শূণ্যে ভেসে দোলার অনুভূতি নিয়ে শিহরণ জাগাবে। পাহাড়ের ঢালজুড় জারান্ট হামক যেখানে বসে বা শুয়ে নিরিবিরি প্রকৃতি অনুভব করা যায় নিজের মতো করে। পাহাড়ের পাদদেশে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হ্রদ ভ্রমণে কায়া কিং উপভোগের দারুন এক সুযোগ।
বাচ্চাদের জন্য রয়েছে চিলড্রেনক্টিভিটিস এক এলাকা। বেস ক্যাম্পের সবকিছুই আউটডোর কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আর্চারি, ওয়াটার জিপলাইন, ক্রলিং, মাডট্রেইল, প্যাডেল বোটিং, ওয়াটার জিপলাইন, রিভার ক্রসিং। ভ্রমণের পূরিপূর্ণতা দিতে সান্ধ্যকালীন সময়ে পুরো ক্যাম্প জুড়ে নাইটসাফারির ব্যবস্থা। ফয়েস লেক বেস ক্যাম্পে ভ্রমণ আরও রোমাঞ্চকর করতে খোলা আকাশের নিচে তাবু টাঙিয়ে রাত কাটানোর সুব্যবস্থা। হ্রদ ভ্রমণে কায়া কিং উপভোগের দারুন এক সুযোগ রয়েছে। রয়েছে প্রাতঃরাশ থেকে শুরু করে দুপুর ও বিকেলের খাবারসহ বারবিকিউ-এর আয়োজন।
এছাড়া পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। শনিবার (১৩ এপ্রিল) ঈদের তৃতীয় দিন অবসর কাটাতে সাগরের কাছে ছুটে আসেন বিনোদনপ্রত্যাশীরা। শিশু-কিশোর-প্রবীণ নানা বয়সী মানুষ দল বেধে ছুটে আসেন ঈদের আনন্দ সাগরের তীরে এসে আরও বাড়িয়ে নিতে।
শনিবার বিকালে দেখা যায়, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতেও প্রচুর লোক সমাগম। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সমুদ্রের পানিতে গোসল করেছেন। আবার কেউ স্পিড-বোটে চড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেউ কেউ সমুদ্রের পাড়ে বসে গান গেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছেন। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত এ সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য পর্যটকদের কাছে যেন এক অন্যরকম মনোমুগ্ধকর ঘটনা।
শনিবার বিকালে আনোয়ার হোসেন নামে এক চাকরিজীবী পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। তিনি বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত অন্যরকম একটি বিনোদনের স্থান। যেখানে সাগরের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য অপেক্ষমাণ সারি সারি জাহাজ এ সৈকতের পরিবেশকে ভিন্নতা এনে দিয়েছে। সাগরপাড়ে এলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কর্মব্যস্ত জীবনে সুযোগ পেয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসেছি।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় দায়িত্বরত ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. ইসরাফিল মজুমদার বলেন, ঈদের দ্বিতীয় দিনের মতো তৃতীয় দিন সকাল থেকেও এই সমুদ্র সৈকতে প্রচুর দর্শনার্থী এসেছে, যার সংখ্যা অর্ধ লাখের বেশি হবে। দর্শনার্থীরা যাতে কোনও ধরনের সমস্যায় না পড়েন এ জন্য আমরা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ সবসময় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় কাজ করছে। কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
নগরের পাশাপাশি জেলার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও ভিড় দেখা গেছে। বিশেষ করে সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সাগরপাড়, চন্দ্রনাথ পাহাড়, মিরসরাইয়ে মহামায়া লেক, আনোয়ারায় পারকি সমুদ্র সৈকত, কর্ণফুলী নদীর পাড়, রাউজান রাবার বাগান, ফটিকছড়ি চা বাগানেও ভিড় জমেছে দর্শনার্থীদের।