শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের ওপর হামলা. থানা ও ট্রাফিক বক্সে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা হয়। এরপর থেকে ‘নিরাপত্তার অভাবে’ কাজে ফিরেননি ট্রাফিক সদস্যরা। এমন অবস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে। তাদের সাথে আছেন স্কাউট, বিএনসিসি এবং আনসার সদস্যরাও। যাদের অনেকেই নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য অংশ নিয়েছে এ কাজে। ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ছাত্র-ছাত্রী ও দুর্ব্যবহারসহ নানা কারণে সমালোচনার শিকার হচ্ছে এই উদ্যোগ। বাড়ছে ক্ষোভও।
যাত্রী-চালকদের অভিযোগ, যারা সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের মধ্যে আছে অছাত্র, মাদকসেবিও। যারা সড়কের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে করা হচ্ছে তল্লাশি। ফলে যাত্রী ওঠা-নামাতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের চোখ রাঙানির শিকার হতে হচ্ছে। লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীদের।
শনিবার (১০ আগস্ট) বিকেল নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কেউ দাঁড়িয়েছেন সড়কের মাঝখানে, কেউ বিভাজনের ওপর আবার কেউ একপাশে। প্রায় ৮০-১০০ জনের প্রত্যেকের মুখে বাঁশি, হাতে লাঠি। ১২ বছরের শিশু থেকে শুরু করে তাদের মধ্যে আছে যুবকরাও। গাড়ি এসে দাঁড়ালেই তাড়া দেওয়ায় যাত্রী তুলতে সময় পাচ্ছেন না বাসচালকরা।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যায়, বেলা সাড়ে ৪ টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন তিন যুবক। তাদের কারো মাথায় ছিল না হেলমেট। একজন ছাত্র তাকে থামাতেই কেড়ে নেন গাড়ির চাবি। চালকের ব্যাখ্যা শোনার আগেই চড়াও হন তিনি। দাড়িয়ে থাকতে বলেন ১০ মিনিট। পরে আরও দু‘জন শিক্ষার্থী যান সেখানে। এরপর তারা চালককে বুঝিয়ে যেতে দেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী মোর্শেদ খান চকবাজার থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগ সাধুবাদ জানানোর মতো। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের এই উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। আগে অনেক সড়কে অফিস যাওয়া-আসার পথে যানজট পেতাম না। এখন ২০ মিনিটের জায়গায় ঘণ্টা পার হচ্ছে। আবার বিভিন্ন স্টপেজে দাঁড়াতেও দিচ্ছে না। একেকজন একেক জায়গায় দাঁড়াতে বলে।’
স্থানীয়রা জানান, গত চারদিনে নগরের বহদ্দারহাট, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, নিউমার্কেট মোড়, সদরঘাট, টাইগারপাস, আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, কাস্টমস, হালিশহর, অলংকার, নয়াবাজার, বারিক বিল্ডিং, ওয়াসা, জিইসি, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি মোড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন, কোন কোন মোড়ে ৮০-১০ জন শিক্ষার্থী লাঠি-বাঁশি হাতে সামলাচ্ছেন ট্রাফিকের দায়িত্ব। বেশিরভাগ সড়কে যানজট আগের তুলনায় বেড়েছে অনেকাংশ। এতে অনেক শ্রমজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিনই।
শনিবার (৯ আগস্ট) সন্ধ্যায় নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে আনুমানিক ৮০-১০০ জন শিক্ষার্থী সামলাচ্ছিলেন ট্রাফিক। তাদের অনেকের গলায় ছিল না আইডি কার্ড। অনেকে রাস্তার মাঝেই গাড়ি আটকিয়ে চেক করছিলেন লাইসেন্স। ফলে পেছনের গাড়িগুলোর গতি কমিয়ে দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে যানজট।
স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বহদ্দারহাটে ট্রাফিক কন্ট্রোল করার জন্য ১০-১৫ জনই যথেষ্ট। অথচ ৮০-১০০ জন মিলে নিজেরাই জ্যাম করে বসে আছে। হ্যারাসমেন্ট করতেছে সেটা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। আমি নিজেও ছাত্র এবং শুরু থেকেই আমি ছাত্র আন্দোলনের সাথেই আছি। রাস্তায় মিছিল যেমন করছি ফেসবুকে লেখালিখিও করছি।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তা-ঘাট পরিস্কার করছে, ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে; এসব কাজ নিশ্চয় প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বর্তমানে ট্রাফিক কন্ট্রোলের নামে একজনের জায়গায় ২০ জনের অবস্থান। হ্যাঁ, ওরা ট্রাফিক পুলিশের মত প্রফেশনাল না। তাই ওদের বেশি সংখ্যক জনবল দরকার। তাই বলে বহদ্দারহাটে দুই-তিনজন পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতো সেখানে ৮০ থেকে ১০০ জন! ওরা নিজেরাই রাস্তা জ্যাম করছে। আর মুখের ভাষা শুনলে মনে হবে না ওরা স্টুডেন্ট।’
শোয়াইব সম্রাট নামে একজন বলেন, ‘রাস্তার খুব বাজে অবস্থা করে রাখছে ওরা। এমন কিছু জায়গায় কোনো ট্রাফিক দরকার নাই। শুধু শুধু ১০ থেকে ১৫ জন দাঁড়িয়ে জ্যাম লাগাচ্ছে। কয়েকজন দেখি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াচ্ছে গাড়ি চলন্ত অবস্থায়। ডাক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি কয়েকজনকে। এভাবে চলতে থাকলে কখন বিপদ হয় বলা যায় না।’ অথচ এদের মাথায় কোন হেলমেট নেই।
আসিফ মোরশেদ নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি গ্রুপে লিখেছেন, ‘এক মোড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন, এমনকি ১০০ জনও আছে। কেউ বলে ডানে যান, কেউ বলে বামে। কেউ বয়সের জোশে চলন্ত গাড়ির সামনেই চলে আসছে গতিরোধ করার জন্য। আরেক দল রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডিভাইডারের কাজ করছে। চলন্ত বাস গাড়ির সাথে লাগে লাগে অবস্থা। আরেক দল সেলফি উঠাইতেছে। তাদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ বছরের ছেলেও আছে। তারা তো ঘর থেকে বের হতেই পারমিশন লাগে। তারা কি নিয়ন্ত্রণ করবে?’
এদিকে আগ্রাবাদ মোড়ে শনিবার অবস্থান করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা হেলমেটবিহীন চালকদের সতর্ক করছেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের সাথে আছেন স্কাউটস, বিএনসিসি এবং আনসার সদস্যরা। অনেক সিএনজি অটোরিকশা এবং বাইক চালককে উল্টোপথে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের নজরে আসার সাথে সাথেই তারা তাদের বুঝিয়ে সঠিক পথে যেতে বাধ্য করেছেন।
জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আগে জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে আপত্তি হতো না। এখন চেক করায় তাদের আপত্তি। তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। হেলমেট ছাড়া বাহির হবে, প্রতি মোড়ে মোড়ে ধরবে কেন— এটা নিয়েও অভিযোগ। এখন ওভারটেক করতে পারে না এতেও সমস্যা।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পরিবর্তন চাচ্ছি আমরা, অথচ পরিবর্তন নিজেরা হতে চাচ্ছি না। অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার জন্য একপাশে লাইন খালি রাখে এটাতেও সমস্যা। কালকে দেখলাম অনেকে অভিযোগ দিচ্ছে— একপাশে লাইন ফাঁকা রেখে অপর পাশে গাড়ি আটকায় কেনো। অথচ, ওই লাইন যে কেনো ফাঁকা রাখছে তা বুঝে না বাঙালি।’
এর আগে শুক্রবার (৯ আগস্ট) রাতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি ভিভিও বার্তা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে ভাই-বোনেরা রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন কাজে নেমে পড়েছেন প্লিজ আপনারা একটি বিষয় মাথায় রাখবেন। যারা ট্রাফিকে কাজ করছেন আপনারা প্লিজ কাউকে আঘাত করে কিছু করবেন না। আপনারা পথচারীদের সম্মানের সহিত হ্যান্ডেল করবেন।’
রাসেল আরও বলেন, ‘কেউ ট্রাফিক আইন অমান্য করলে তাহলে তাদের বোঝাবেন। আপনারা কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখেন না। রাষ্ট্র আপনাদের সেই ক্ষমতা দেয়নি। অতএব বোঝাবেন তাদের। আমাদের যে বোনেরা কাজ করছেন তারা সন্ধ্যা নামার আগে বাসায় ফিরবেন।
‘আর যারা ছোট ছোট ভাই-বোনেরা কাজ করার জন্য আসছেন; হয়তো আবেগ থেকে আসছেন। অনেকেই তারা বোঝে না। যারা সিনিয়র আছেন তারা খুব ছোটদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।