চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের এইচএসসির রেজাল্ট কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন তিনি। ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে বসেছেন বোর্ড সচিবের চেয়ারে। এবার নিজপুত্রের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট কারসাজি নিয়ে নতুন বিতর্কে জড়িয়েছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ।
রেজাল্ট কারচুপির এই ঘটনা অতি জ্ঞাতসারে ঘটলেও ঘটনাটি গোল পাকে পুন:নিরীক্ষণের আবেদনের পর। অর্থাৎ অনলাইনে যথানিয়মে সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের পূত্র নক্ষত্র দেবনাথের ১২ পত্রের খাতা পূন:নিরীক্ষণের আবেদন করা হয়। যা দেখে চোখ কপালে উঠে সচিবের।
বোর্ড সচিব কিছুতেই চাইছেন না তার ছেলের খাতাগুলো পুনঃনিরীক্ষা করা হোক। ফলে গত ২৬ নভেম্বর এবারের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পর গত ৪ নভেম্বর রাতে তার স্ত্রী বনশ্রী নাথকে দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
শুধু তাই নয়, একই দিন সচিবের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন, তার খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন যেনো বিবেচনা করা না হয়। এরপর বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে আসে।
জিডিতে সচিবের স্ত্রী বনশ্রী নাথ বলেন, বোর্ডের নিয়ম অনুসারে একটি বিষয়ের খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ছেলের রোল নম্বরের বিপরীতে আগেই কেউ আবেদন করে রেখেছে। বিষয়টি অতীব সন্দেহজনক এবং দুরভিসন্ধিমূলক। এতে কোনো কুচক্রী মহলের খারাপ পরিকল্পনার ইঙ্গিত রয়েছে। যা ভবিষ্যতে তার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ওই ঘটনার পর থেকে নানামুখী গুঞ্জন শুরু হয় সংশ্লিষ্ট পরিমন্ডলে। প্রশ্ন আসে সচিবের ছেলের ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন কে করলো? কেনইবা এটা তদন্ত করতে সচিবের স্ত্রী থানায় অভিযোগ করলেন? আর পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন বিবেচনা না করতে সচিবের ছেলে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করলেন কেন?
এই ঘটনার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল। হাতে আসে সচিবের ছেলের এইচএসসিতে ভর্তি সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র। সেখানে দেখা যায়, এসএসসির পর তিনি যে কলেজে ভর্তি হয় সেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সর্বনিম্ন যোগ্যতা ছিলো জিপিএ-৫। অথচ রেজাল্টে দেখা যায়, সচিবের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ জিপিএ-৫ পাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, নারায়ণ চন্দ্র নাথ নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে ছেলেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তির সব সুবিধা আদায় করেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরেক তথ্য। সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে গেছেন সিঙ্গাপুরে। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিল্পগ্রুপের প্রভাবশালী মালিকের কাছে। যার সুপারিশে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তার সফরসঙ্গী হয়েছেন দৈনিক প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিস থেকে অব্যাহতি পাওয়া এক সাংবাদিক। যিনি বর্তমানে একুশে টিভির চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত আছেন। তিনি দুর্নীতিপরায়ন সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। সিঙ্গাপুর থেকে তারা ফিরেছেন মঙ্গলবার দিবাগত রাতে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার। তিনি বলেন, সচিব সাহেব ব্যক্তিগত ছুটিতে আছেন। তবে শুনেছি তিনি সিঙ্গাপুর গেছেন। তবে কেন গেছেন তা আমার জানা নেই। ধারণা করছি, বেড়াতে গেছেন। সচিবের সাথে সাংবাদিকের সফরসঙ্গি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলা কি আমার উচিত-প্রশ্ন করেন চেয়ারম্যান প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার।
নিজ পুত্রের এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট কারচুপি নিয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এসএসসির পর কিভাবে সচিবের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তি হয়েছেন সেটা আমি জানি না। তখন আমি ছিলাম না। সম্ভবত বিশেষ কোটায় ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু কলেজ সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, বিশেষ কোটার আওতায় পড়েন না সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ।
বোর্ডের চেয়ারম্যান আরও বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট কারচুপি করেছেন কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। আর এ নিয়ে প্রশ্নই বা উঠছে কেন?। ছেলেটার খাতা পুন:নিরীক্ষণের বিষয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তা লিগ্যাল বা নিয়মতান্ত্রিক নয়। কারণ খাতা পুন:নিরীক্ষণের আবেদনকারী শিক্ষার্থী বা তার অভিবাবক কেউ নন। যদি আবেদন লিগ্যাল হত তাহলে অবশ্যই পুন:নিরীক্ষণ করা হতো।
বরং আবেদনকারি কে, এই আবেদন করার উদ্দেশ্য কি, তা বের করার চেষ্টা চলছে। আবেদনকারিকে যদি শনাক্ত করা যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ চাকমাও বলেন একই কথা। তিনি বলেন, বোর্ড সচিবের ছেলের হয়ে কে বা কোন চক্র খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছে, সেটা বের করতে আমরা চেষ্টা করছি।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ড সংশ্লিষ্টদের মতে, সচিবের ছেলের সব খাতাতেই অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে। বিষয়টি প্রকাশ করতেই এ স¤পর্কে ওয়াকিফহাল কেউ আবেদন করে থাকতে পারেন। কিন্তু বোর্ড চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আবেদনকারির পেছনে ছুটছে। খাতাগুলো পুন:নিরীক্ষণ হলেই তো থলের বেড়াল বেরিয়ে যেত।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বর্তমান বোর্ড সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থাকাকালে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের দিন সকালে দেখা যায়, ওয়েবসাইটে কোনো কোনো শিক্ষার্থী কয়েকটি বিষয়ে ২০০ পূর্ণমানের পরীক্ষায় ২১৮ মার্কস পেয়েছেন। সন্ধ্যার পর ওই ফলাফল পরিবর্তন করা হয়। এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হলে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করে।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর হুছাইন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্য স¤পাদন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ফলাফল প্রসেসিং রুমের ক¤িপউটারের টেবুলেশন অনিরাপদ রাখায় ফলাফল তৈরিতে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা অনাকাঙ্খিত। বোর্ডের নীতিমালায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও আইটি টিমের সদস্যরা নিজেরাই ফল সংশোধন করতে যান। তাতে দু‘ধরনের নম্বর ফর্দ প্রকাশ হওয়ায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড স¤পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। যেহেতু পরীক্ষার ফলাফল তৈরি সংক্রান্ত সকল দায়-দায়িত্ব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের, সেহেতু এর স¤পূর্ণ দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপর বর্তায়।
কিন্তু ওই দায়ের কারণে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি নিজ পদেই বহাল থাকেন। এমনকি চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর তিনি পদোন্নতি পেয়ে সচিব হন। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে আগের ঘটনাগুলোতে পার পেয়ে যাওয়ায় তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে কথা বলতে গত বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে গেলেও ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলার সময় নেই জানিয়ে অফিস ছেড়ে চলে যান সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ। এর আগে তিনি আরও কয়েকজন সাংবাদিককেও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অফিস কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেননি বলে অভিযোগ উঠে।
ঈশান/খম/সুম