চট্টগ্রামের পাহাড়তলী নয়াবাজার বিশ্বরোড এলাকায় আজাদুর রহমান (৩০) নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে দূর্বৃত্তরা। রবিবার (২৮ মে) ভোরে এ ঘটনা ঘটে। আর এই হত্যাকান্ডে জড়িত দূর্বৃত্তরা চসিকের প্যানেল মেয়র ও ২৫ নং রামপুরা ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটনের আনুসারি বলে অভিযোগ উঠেছে।
শুধু তাই নয়, দূর্বৃত্তরা লিটনের ভাই আবদুল মান্নান খোকনের নেতৃত্বে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা জানান, দূর্বৃত্তরা খোকনের নেতৃত্বে এলাকায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, জুয়া ও মাদক পাচারের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত রয়েছে।
একই অভিযোগ তুলেন নিহত আজাদের স্ত্রী নাজু বেগমও। সোমবার (২৯ মে) দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বামীর শোকে বিলাপ করতে করতে স্ত্রী নাজু বেগম বলেন, রাজীব, হোসেন, ফয়সাল, ওসমানসহ সাতজন মিলে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। লিটন কমিশনারের কারণে এই ছেলেগুলো আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। আমার দুইটা মেয়েকে এতিম করে ফেলেছে। লিটন কমিশনারের ফাঁসি চাই। হত্যাকান্ডে জড়িতদের সবার ফাঁসি চাই।
তিনি বলেন, হত্যাকান্ডে জড়িতরা চাঁদাবাজি, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই করে। কিছুদিন আগে নগরের নয়াবাজার এলাকায় চাঁদাবাজিতে বাধা দিয়েছিল আজাদ। পরবর্তীতে রবিবার ভোরে নামাজে যাওয়ার সময় পথ আটকে তাকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। এসময় গুরুতর আহত অবস্থায় আজাদকে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় খুনিদের নাম আবুল হাসনাত রাজু প্রকাশ রাজু, ফয়সাল ও ওসমান বলে জানায় আজাদ। এরপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
নিহত আজাদের বড় ভাই মফিজুর রহমান বলেন, আমার ভাইকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে রাজু, ফয়সাল ও ওসমানসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। তারা সবাই প্যানেল মেয়র ও রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটনের আনুসারি। তার ভাই খোকনের নেতৃত্বে এরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়। আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই। শুধুমাত্র চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তারা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে ফয়সাল, রাজু ও ওসমানরা তাদের গ্রুপ নিয়ে ওই এলাকায় কয়েকটি দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিল। তাদের চাঁদাবাজিতে বাধা দেয় আমার ভাই আজাদ। আর এ ঘটনার জের ধরেই তারা ভোররাতে ফজরের নামাজের সময় আজাদকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় আমরা থানায় মামলা করেছি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আজাদ একজন নিরপরাধ, সহজ-সরল, খেটে-খাওয়া মানুষ। নতুন বাজার এলাকায় গাড়ির গ্যারেজের পাহারাদার হিসেবে কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে বড়শি শিকারিদের সঙ্গে যেতেন। শ্রমের বিনিময়ে সামান্য টাকা উপার্জন করে পরিবার চালাতেন। হত্যাকারীরা আগে থেকেই আজাদকে চিনতো। এর আগে তাদের সঙ্গে চাঁদা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছিল। হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি একই এলাকার বাসিন্দা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্তরা সবাই কাউন্সিলর লিটনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন দোকানে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জুয়া ও মাদকের কারবার করে এলাকায় রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করে আসছে তারা। কাউন্সিলর লিটন ও খোকনের সাথে মূল অভিযুক্ত আবুল হাসনাত রাজুর তোলা একাধিক ছবি রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাউন্সিলর লিটনের ছোট ভাই খোকনের বেপরোয়া-বিতর্কিত কর্মকান্ডে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত। এলাকায় নিত্য চাঁদাবাজি, জুঁয়ার আসর, মাদক সেবন ও পাচারসহ নানা অপরাধ করে বেড়ায় খোকন। আর অনুসারী হিসেবে পরিচিত দূর্বৃত্তরা এসব অপরাধ কর্মকান্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগী।
আব্দুল মান্নান খোকনের বিরুদ্ধে নগরের পাহাড়তলীর ভেলুয়ার দীঘি ও ডেবার পাড় এলাকায় বড়শি প্রতিযোগিতার আড়ালে দিনে-দুপুরে জমজমাট জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে, বড়শি প্রতিযোগিতার নামে এ জুয়ার আসরের আয়োজন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন খোকন। আর সবকিছুর মূলে প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন।
এর আগে ২০২১ সালের ৩ মে হালিশহর থানার ঈদগা বড়পুকুর পাড় এলাকার একটি অসহায় পরিবারের উপর হামলা অভিযোগ উঠে আবদুল মান্নান খোকনের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, তাদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন খোকন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নিজে উপস্থিত থেকে কিশোর গ্যাং দিয়ে প্রকাশ্যে ওই পরিবারের উপর হামলা চালান খোকন। এসময় একটি রিকশা গ্যারেজ এবং ঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি ওই পরিবারের সদস্যদের মারধরের অভিযোগ তুলেন ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আব্দুল মান্নান খোকনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় জানার সাথে সাথে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিন্তু চসিকের প্যানেল মেয়র ও ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন মুঠোফোনের হুয়াটসঅ্যাপে বলেন, আমি রাজনীতি করি। আর রাজনীতি কোন মৌলভি নিয়ে হয় না। আমার অনুসারি দুয়েকজন খারাপ থাকতেই পারে। তাই বলে অপরাধ কর্মকান্ডে আমি জড়িত এটা ঠিক নয়।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রপচার চালানোয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সোমবার দুপুরে এলাকায় বড় ধরণের প্রতিবাদ শোডাউন করেছে। এই অপপ্রচারের আমি তীব্র নিন্দা জানাই।
পাহাড়তলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রোজিনা আক্তার বলেন, মৃত্যুর আগে ভিকটিম খুনিদের নাম বলে গেছেন। সে হিসেবে আমরা ধরে নিয়েছি এরাই খুনি। ভিকটিমের দেয়া তথ্যমতে রাজু, তার ভাই রাজীব, ওসমান ও ফয়সাল এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদেরকে র্যাব গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।
র্যাবের জালে চার খুনি :
পাহাড়তলীর নয়াবাজার এলাকায় আজাদুর রহমান (৩০) নামে এক যুবককে এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাতে খুনের ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, নগরীর হালিশহরে মো. আবুল হাসেমের ছেলে আবু তাহের রাজীব (২৩), লক্ষীপুর সদরের সংসেরাবাদ এলাকার মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন জয় (২৭), হালিশহরের মো. ইব্রাহিমের ছেলে মো. রায়হান সজীব, নয়াবাজার এলাকার আবুল হাসেমের ছেলে আবুল হাসনাত রানা (৩০)। র্যাবের দাবি, তারা আজাদ খুনে স¤পৃক্ত বলে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
সোমবার (২৯ মে) রাঙামাটি জেলার সদর থানাধীন একটি আবাসিক হোটেল এবং নগরীর কদমতলী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাব ৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নূরুল আবছার।
তিনি বলেন, ঘটনার আগে শনিবার (২৭ মে) রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার সময় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নগরীর নয়াবাজার এলাকার একটি কারখানার গেইটের সামনে প্রস্রাব করলে কারখানার নৈশ প্রহরী নিহতের বড় ভাই মফিজ (৪০) তাকে বাধা প্রদান করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ব্যক্তি নৈশ প্রহরী মফিজকে বলে, এটা সরকারি জায়গা তুই বাধা দেওয়ার কে? আর এমন এই বিষয় নিয়ে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আসামি আবু তাহের রাজীব, ওসমান, আবুল হাসান এবং আরও কয়েকজন ওই স্থানে গিয়ে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়। এদিকে বড় ভাইয়ের সাথে কথা কাটাকাটির শব্দ শুনে নিহত আজাদুর রহমান ঘটনাস্থলে গেলে তার সাথেও কথা কাটাকাটি এবং এক পর্যায়ে ধাক্কা-ধাক্কির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে আসামিরা ভুক্তভোগীকে দেখে নিবে বলে হুমকি প্রদান করে চলে যায়।
এই ঘটনার জের ধরে রবিবার দিনগত রাতে ভোরের আলো ফোটার পরপরই ভিকটিম আজাদুর রহমান দোকান থেকে নাস্তা আনার জন্য বাসা থেকে বের হন। নয়াবাজার পৌঁছালে ওঁৎ পেতে থাকা আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভুক্তভোগীকে একা পেয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলাপাথাড়িভাবে পেটে, পিঠে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভুক্তভোগীকে ফেলে তারা পালিয়ে যায়। ছুরিকাঘাতের ফলে ভুক্তভোগীর পেটের ভুড়ি বের হয়ে যায়। ভুক্তভোগীর চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।