মঙ্গলবার- ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অবসরের পরও চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান থাকতে রেজাউলের দৌড়ঝাপ!

অবসর পেয়েও চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান থাকতে রেজাউলের দৌড়ঝাপ!
print news

বিধি মোতাবেক চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে ৩১ শে জানুয়ারী অবসর পাচ্ছেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। কিন্তু চেয়ারম্যানের চেয়ার ছাড়তে খুব কষ্ঠ তাঁর। কারণ অবসরের প্রাক্কালেও চেয়ারে থেকে কলমের খোঁচায় হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এমন মধুর চেয়ার ছাড়তে কে চান? তাই চেয়ারম্যানের পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে আবারও দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আশীর্বাদপুষ্ট রেজাউল করিম।

এ নিয়ে লেখালেখি করার ক্ষোভে সাংবাদিকদের সাথেও অসাদাচারণ শুরু করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে শারমীন রিমা নামে এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিতও করেছেন। নওফেল ক্ষমতাচ্যুত হলেও তার খুটির জোর নাকি সেনাবাহিনীতে থাকা মেজর ভাই। যার কথা বলে প্রতিনিয়ত শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভীত রাখতেন। করতেন নানা অনিয়ম ও দূর্নীতি। হাতাতেন অর্থ।

এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাদের মতে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব থাকাকালীন ওএমআর শিট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অধ্যাপক রেজাউল করিমকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদলি করা হয়।

এরপর ফন্দিফিকির করে মেজর ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সুপারিশে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যান পদে ফিরে আসেন তিনি। এর পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন রেজাউল করিম। পরীক্ষার দায়িত্ব পালন না করেও তুলে নেন অর্ধ লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে অবসরের দু‘দিন আগে অনুমোদন দেন ফ্যাসিবাদ সমর্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের এডহক কমিটি।

শুধু তাই নয়, অবসরের প্রাক্কালে অনৈতিক ও বিধি লঙ্ঘনের কারণে শিক্ষাবোর্ডে আটকানো সব ধরণের ফাইলে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে স্বাক্ষর করে বৈধতা দিয়েছেন রেজাউল করিম। অবৈধ এই অর্থের ঘ্রাণে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে চান না তিনি। তাই অবসরের পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন রেজাউল করিম। সেখানেও নিজের মেজর ভাইয়ের প্রভাব খাটাচ্ছেন-এমন খবর পাচ্ছেন বলে জানান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

সূত্র জানায়, রেজাউল করিমকে এ কাজে সহযোগীতা করছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড থেকে দূর্নীতির দায়ে সদ্য মাউশিতে বদলি হওয়া উপ সচিব মো. বেলাল হোসেন। তিনি ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন। শিক্ষা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দুটি তদন্তের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠে রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। আর এই কাজে তাকে সহযোগীতা করেন উপসচিব মো. বেলাল হোসেন। কিন্তু অবসরের সময় হওয়ায় স্বপদে থেকে যান চেয়ারম্যান রেজাউল।

পরীক্ষার দায়িত্বে না থেকেও সম্মানী নেন বোর্ড চেয়ারম্যান:

চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় গত ১২ মে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউল করিম দায়িত্ব নেন আরও দুই দিন পর ১৫ মে। এর আগ পর্যন্ত পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমে যুক্ত না থেকেও তিনি সম্মানী বাবদ ৮৪ হাজার ৯৪৭ টাকা তুলে নেন। দায়িত্ব পালন না করে তাঁর এই টাকা নেওয়া নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিবছর ৮টি করে ১৬টি সম্মানী পান। এর মধ্যে পরীক্ষার্থীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করলে মূল বেতনের অর্ধেক, পরীক্ষার প্রবেশপত্র বিতরণের পর অর্ধেক, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মূল বেতনের সমপরিমাণ ও ফলাফল প্রকাশের পর মূল বেতনের অর্ধেক সম্মানী দেওয়া হয়। এর বাইরে ব্যবহারিক পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই, পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশ, নম্বরপত্র ও সনদ বিতরণ করলে বিভিন্ন অনুপাতে আরও চারটি সম্মানী পান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বোর্ডের নথিতে দেখা গেছে, ব্যবহারিক পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই ও পরীক্ষা শেষ করায় দুটি সম্মানী বণ্টনের জন্য তৎকালীন চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র নাথ বরাবর আবেদন করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। ১৪ মে এ আবেদন করা হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওই দিনই আবেদনপত্র অনুমোদন করে সম্মানী বণ্টনের জন্য হিসাব ও নিরীক্ষা শাখার উপপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠান।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

পাশাপাশি ১৪ মে অধ্যাপক রেজাউল করিমকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তিনি ১৫ মে যোগ দিয়ে পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজের সম্মানী বাবদ মূল বেতনের অর্ধেক ৩২ হাজার ৩০ টাকা গ্রহণ করেন। ১৬ মে এ টাকা বণ্টন করা হয়।

বোর্ডের প্রণোদনা বণ্টনবিষয়ক একটি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার মোট ব্যবহারিক উত্তরপত্রের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫১ হাজার ৭০৪। প্রতি উত্তরপত্র বাবদ ৫ টাকা হারে ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বণ্টন করা হয়। চেয়ারম্যান রেজাউল করিম চৌধুরী সম্মানী পেয়েছেন ৫২ হাজার ৯১৭ টাকা। ১১ জুন অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে এ টাকা পান চেয়ারম্যান।

এছাড়া চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় চেয়ারম্যান পদে আট মাস দায়িত্ব পালন শেষে চলতি মাসের ৩১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরোত্তর ছুটিতে যাচ্ছেন রেজাউল। তবে অবসরে যাওয়ার সুবিধার্থে বোর্ড থেকে ২৯ তারিখে রিলিজ নেবেন বোর্ডের এ কর্মকর্তা। যদিও পিআরএলে যাওয়ার দশ দিন আগেই গত ২১ জানুয়ারি প্রেষণ প্রত্যাহার করে তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক বোর্ড চেয়ারম্যান হতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম। ইতিমধ্যে তিনি কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদের সুপারিশও নিয়েছেন। এসব বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরীর জন্য গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) তথ্য ও মন্তব্য চাওয়ায় শারমিন রিমা নামে এক নারী সাংবাদিকের সঙ্গে আশোভন আচরণ করেন অধ্যাপক রেজাউল করিম।

নওফেলের পা চাটেন যেভাবে

শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, রেজাউল করিম শিক্ষা বোর্ডের সচিব হয়েছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আশীর্বাদে। নওফেলের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছেন বেপরোয়াভাবে। এ কারণে সে সময়ের বোর্ড চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম তার উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে আগুনে পুড়েছে ৯ বসতঘর, দু‘জনের প্রাণহানী

এক পর্যায়ে ওএমআর শিট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অধ্যাপক রেজাউল করিমকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদলি করা হয়। কিন্তু ছলচাতুরী আর মেজর ভাইয়ের প্রভাবে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের সুপারিশে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে ফিরে আসেন তিনি।

সে কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়েই উপ সচিব মো. বেলাল হোসেনসহ কয়েকজনকে নিয়ে নওফেলের প্রয়াত বাবা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবর জেয়ারত করেন। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নওফেলের বাড়িতে হামলার পর চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ও উপ সচিব মো. বেলাল হোসেন বোর্ডের গাড়ি নিয়ে সেখানে যান।

সেখানে এক বক্তৃতায় চেয়ারম্যান রেজাউল করিম প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন-এই হামলায় জড়িত ছাত্রদের স্কুল-কলেজ থেকে খোঁজে খোঁজে বের করা হবে। তাদের পড়ালেখার ইতি টেনে দেবে। বরবাদ করে দিবেন হামলাকারী ছাত্রদের ভবিষ্যত। ছাত্রদের মোকাবেলায় তিনি কোটি টাকা অনুদানেরও ঘোষণা দেন। এই বক্তৃতার একটি ভিডিও দৈনিক ঈশানের অফিসে সংরক্ষণ রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্র-জনতা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাছির উদ্দিন বলেন, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর তার দোসররা নানা ভাবে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। তাদের নানা অপতৎপরতায় দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। তাদের অপসারণ না করলে বোর্ডসহ দেশে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকবে।

ঈশান/মখ/বেবি

আরও পড়ুন

No more posts to show
error: Content is protected !!