বৃহস্পতিবার- ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

আগ্রাবাদ শিশুপার্ক এখন সিক্রেট পতিতালয়!

আগ্রাবাদ শিশুপার্ক এখন সিক্রেট পতিতালয়!
print news

শিশুদের পরিপূর্ণ শারিরীক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে উঠা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শিশুপার্ক এখন সিক্রেট পতিতালয়। যেখানে অন্য যেকোন পরিচয়ে যে কারও প্রবেশের সুযোগ থাকলেও সাংবাদিক পরিচয়ে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই।

সাংবাদিক পরিচয় পেলেই বলা হচ্ছে, পার্ক বন্ধ। এখানে কেউ নেই। এখানে কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। পার্কের মূল ফটকে দায়িত্বরত আনসারদের এমন বক্তব্য হলেও গোপন পথে ঠিকই ঘটছে তরুণ-তরুণীদের প্রবেশ।

শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিকেলে অনুসন্ধান চালিয়ে বের করা হয় সেই গোপন পথ। যেখান দিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে সুযোগ হয় প্রবেশের। আর শুরুতেই খপ্পরে পড়তে হয় দালালদের। স্যার, কিছু লাগব? এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কয়েকজন দালালের।

কি আছে আপনাদের জানতে চাইলে একজন বলেন, স্যার মনে হয় নতুন আইছে। কোন অসুবিধা নাই। আপনি যা বলবেন তাই এনে দিব। না একটু ঘুরে দেখি, তারপর বলব। এমন কথায় সাঁই মিললেও চুপ মেরে যান দালালরা। বলেন, ঠিক আছে স্যার ঘুরে আসেন।

ঘুরতে গিয়ে ঘটে যত বিপত্তি। বিশেষ করে পার্কের ওয়েল জার রাইডটিতে দেখা মিলে চার জোড়া কপোত-কপোতির অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর দৃশ্য। একই অবস্থা পাশের শাপলা ফুলের রাইডটিরও। এ রাইডটিতে এক জোড়া জুটি দৈহিক বিনোদনে ব্যস্ত।

এভাবে প্রায় সবগুলো রাইডের ভেতরেই একাধিক জুটিকে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে দেখা গেছে। রেসিং কার রাইডটির স্থানে কোনো কার দেখা যায়নি। থ্রিডি সিনেমা ও পার্কের পানির ফোয়ারাটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল পড়ে আছে। ফোয়ারার নিচে ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব। দেখে মনে হয়, দীর্ঘদিন পরিষ্কার করা হয়নি। নামে শিশুপার্ক হলেও এখানকার কিডস জোনটিতেও চলছে তরুণ-তরুণীদের লীলা খেলা।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

লেকের মধ্যে স্থাপন করা পাথরের সাদা পদ্মফুল ও ব্যাঙগুলো ধূলা-বালিতে কালো হয়ে আছে। লেকের একপাশে দুটি নষ্ট বোট ফেলে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ রাইডই পরিচর্যার অভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে। যাদের প্রত্যেকটিতে চলছে আসামাজিক কার্যকলাপ।

পার্কের মূল ফটকটিও দীর্ঘদিন রং না করায় কালচে হয়ে গেছে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাম পাশে লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট। যে লেকের ওপর রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত, সে লেকটির পানি দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার ফলে নোংরা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আর এই রেস্টুরেন্টের ভেতরেও চলছে যতসব অপকর্ম।

পার্কের পাশের বিশাল মাঠটিও জুটিদের অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর স্থানে পরিণত হয়েছে। অন্তত ১০ জুটিকে এ মাঠের বিভিন্ন গাছের কোণে বসে আলাপরত দেখা যায়। অথচ মাঠের মধ্যেই চারজন আনসার সদস্য ছিল। তারা সেদিকে নজর না দিয়ে নিজেরা এক কোণে বসে গল্প করছিল।

আশপাশের দোকানিরা জানায়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অবস্থা আরো খারাপ থাকে। তখন আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পার্কে এসে সময় কাটায়। আনসার সদস্যরা কিছু বলে না। তারা শুধু ঘোরাঘুরি করে।

নগরীর পাঠানটুলি এলাকার গৃহিণী নুরজাহান আক্তার বলেন, বাচ্চাকে পার্কে নিয়ে যাওয়ার কোন পরিবেশ নেই। বাচ্চাদের রাইডে তরুণ-তরুণীরা বসে থাকে সবসময়। দেখলে মনে হবে এটা তরুণ-তরুণীদের আনন্দ বিনোদনের পার্ক। যেদিকে দেখি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

তিনি বলেন, পার্কে কিডস জোনের ভেতর জিরাফ, হাতি রয়েছে। কিন্তু পুরো পার্কের অবস্থা জঘন্য। ভালোমতো পরিষ্কারও করা হয় না, ধোয়া-মোছাতো দূরের কথা। শিশু পার্কে যদি বড়রা বসে থাকে, তাহলে শিশুরা কোথায় যাবে?

এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন ওই এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট রোকন আরা হ্যাপি। তিনি বলেন, শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তোলা এই শিশু পার্ক এখন সিক্রেট পতিতালয়। প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎপাতে এই পার্কে ঠাঁই পাচ্ছে না শিশুরা। তাই এই পার্কের ভেতরে প্রবেশ করলে শিশুদের দেখা যায় না। বরং জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতিদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়।

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা অযত্ন আর অবহেলায় নগরীর আগ্রাবাদ শিশুপার্কটি ২০১৬ সাল থেকে বেহাল দশায়। অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে পার্কটিতে শিশু দর্শনার্থী কমে গেছে। মূল ফটকসহ রং উঠে বিবর্ণ হয়ে গেছে বেশিরভাগ রাইডের। দীর্ঘদিন ধরে অচল পড়ে আছে বেশ কয়েকটি রাইড।

রাইডের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পার্কের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আগের চাইতে দর্শনার্থী অনেক কমে গেছে। ছুটির দিন কিছু দর্শনার্থী হয়। আর বেশিরভাগ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আসে।

এ ব্যাপারে শিশু পার্কের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলমান বিভিন্ন মেলার ও বর্ষবরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে পার্কে দর্শনার্থী আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তবে পার্কে শুধু জুটিরাই অন্তরঙ্গ সময় কাটায়, একথা ঠিক নয়। কোনো জুটি বেশি অন্তরঙ্গ হলে আনসার সদস্যরা তাদের সাবধান করে দেয়। এজন্য ১৫ জন আনসার নিয়োগ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন :  মাদক বাণিজ্যেরও গডফাদার ষোলশহর রেল জংশনের মাস্টার জয়নাল!

ওই কর্মকর্তার তথ্যমতে, ১৯৯১ সালে আগ্রাবাদের জাম্বুরি মাঠ সংলগ্ন ৮ দশমিক ৮৬ একর জমি সিটি করপোরেশনকে ইজারা দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০০০ সালে সিসিসির সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তিতে সেখানে শিশু পার্ক বানায় আনন্দমেলা লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যার নামকরণ করা হয় আগ্রাবাদ শিশু পার্ক। প্রবেশ ফি করা হয় ৪০ টাকা।

কিন্তু অনুমতি ছাড়া পার্ক নির্মাণের কারণ দেখিয়ে ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ইজারা বাতিল করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করে সিটি করপোরেশন। মামলাটি বিচারাধীন থাকলেও ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাম্বুরি মাঠ পরিদর্শন শেষে আগ্রাবাদ শিশু পার্কের জায়গায় নভোথিয়েটার বানানোর ঘোষণা দেন তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

তবে শিশু পার্ক বন্ধের বিরোধিতা করে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেছেন, বন্ধের চিন্তা বাদ দিয়ে সিটি করপোরেশনের উচিত শিশুদের জন্য ওয়ার্ডপ্রতি অন্তত একটি বিশেষায়িত পার্ক বানানো। সিটি করপোরেশন চাইলে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত নভো থিয়েটারের পাশেও শিশু পার্কটি রাখতে পারে। তাহলে বিনোদন এবং নভোমন্ডল স¤পর্কে ধারণা দুটিই শিশুরা পাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, শিশুদের পরিপূর্ণ শারিরীক ও মানসিক বিকাশের জন্য পার্কের দরকার। পার্কের জন্য চট্টগ্রামের বাকলিয়া, কুলগাঁও ও কুয়াইশ এলাকায় উপযুক্ত জায়গা রয়েছে।

ঈশান/খম/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show