বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৩ বছরে পাকিস্তান থেকে সরাসরি কোনো জাহাজ আসেনি চট্টগ্রাম বন্দরে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পর গত ১৩ নভেম্বর হঠাৎ প্রথমবারের মতো করাচি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলে পানামা পতাকাবাহী পণ্যবাহী জাহাজ এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং।
জাহাজটিতে পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড়, রং, খেজুর, জিপসাম, পুরোনো লোহার টুকরা, মার্বেল ব্লক, কপার ওয়্যার, রেজিনসহ বিভিন্ন পণ্য থাকলেও ভারতের ধারণা, এর মধ্যে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ছিল। যা ভারতের জন্য হুমকি।
এ নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন মহলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সেই আলোচনা-সমালোচনা শেষ হতে না হতে ৩৮ দিনের মাথায় শনিবার (২২ ডিসেম্বর) রাতে ফের করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে জাহাজটি।
দ্বিতীয়বারের মতো করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজটিতে ৮২৫ টিইইউএস কন্টেনার রয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি করাচি থেকে আসে ৭১২ কন্টেনার। এসব কন্টেনারে রয়েছে ভোগ্যপণ্য, গার্মেন্টস এক্সেসরিজসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল।
করাচি-চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল পাকিস্তান থেকে পণ্য আনা-নেওয়া অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সেই জাহাজ আসার খবরে ফের ঘুম হারাম ভারতের। এমন মন্তব্য করেছেন জাহাজটির পরিচালন সংস্থা শিপিং কো¤পানি রিজেন্সি লাইনস লিমিটেডের মুখপাত্র মাশহুর আলম।
তিনি বলেন, জাহাজটিতে কী কী আনা হচ্ছে সেটি কাস্টমস থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যাবে। তবে এটি নিশ্চিত, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিনিয়ত যেসব পণ্য আসে, সেসব পণ্যই আনা হচ্ছে। বন্দর দিয়ে নিয়মবহির্ভূত কোনো পণ্য খালাস তো হতে পারে না। তাই এটি নিয়ে কোনো ভুল তথ্য না ছড়ায় সেদিকে যেন সবাই সজাগ থাকে।
মাশহুর আলম বলেন, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত পণ্য আসে। ওখান থেকে জাহাজ আসলে সমস্যা কী, সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না। করাচির সঙ্গে তো নৌ-বাণিজ্যে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। জাহাজটি নিয়ে ভারতের এত মাথা ব্যাথা কেন সেটাও তো বুঝতে পারছি না। ভারত আসলে কি চাই, সেটা সম্প্রতি পরিস্কার হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র ও উপ-কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, আইজিএমের ঘোষণা অনুযায়ী জাহাজটিতে থাকা ৮২৫ টিইইউএস কন্টেনারের মধ্যে ২৮৫ টিইইউএস কন্টেনারে পরিশোধিত চিনি, ১৭১ টিইইউএস কন্টেনারে ডলোমাইট, ১৩৮ টিইইউএস কন্টেনারে সোডা অ্যাশ, ৪৬ টিইইউএস কন্টেনারে গার্মেন্টসের কাপড়ের রোল, ২০ টিইইউএস কন্টেনারে আখের গুড়, ১৮ টিইইউএস কন্টেনারে আলু এবং ২০ টিইইউএস কন্টেনারে পুরনো লোহার টুকরা, রেজিন ও কাপড় রয়েছে।
এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জাহাজটিতে বোঝাই করা কন্টেনারে খেঁজুর, লুব অয়েল, মার্বেল পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। জাহাজটি আজ বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালে বার্থিং নেবে। পণ্যগুলো খালাসের পর জাহাজটি ফিরতি পথে ১২০০ টিইইউএস পণ্য বোঝাই ও খালি কন্টেনার নিয়ে আগামী ২৪ ডিসেম্বর বন্দর ছেড়ে যাবে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান থেকে তো সবসময়ই নিয়মিত পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও রাসায়নিক, খনিজ পদার্থ, ক্লিংকার ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য পণ্য আসে। এবারও জাহাজটিতে এসব পণ্য থাকতে পারে। তাই পাকিস্তান থেকে কোন জাহাজ আসছে বা কী পণ্য আসছে, সেটিকে আমরা আলাদা করি দেখি না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি হয়ে আসা এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং নামের কন্টেনার জাহাজটি সোমবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে জাহাজটিকে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের দুই নম্বর বার্থে বার্থিং দেওয়া হয়। জাহাজটিতে প্রথমবারের চেয়ে প্রায় তিন গুণ কন্টেনার রয়েছে।
শিপিং এজেন্সি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজেন্সি লাইনস লিমিটেডের পরিচালনাধীন এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং নামের পণ্যবাহী জাহাজ করাচি থেকে সরাসরি প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ১১ নভেম্বর। জাহাজটি থেকে ৩৭০ একক কন্টেইনার নামানো হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে আনা হয়েছে ২৯৭ একক কন্টেইনার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আনা হয়েছে ৭৩ একক কন্টেইনার।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তানের ১৮টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ছয় হাজার ৩৩৭ টন পণ্য আনা হয়। পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ, যা টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। এতে মোট ১১৫ কন্টেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য হলো খনিজ পদার্থ ডলোমাইট। ডলোমাইট রয়েছে ৪৬ কন্টেইনারে। মোট ৩৫ একক কন্টেইনারে আনা হয়েছে চুনাপাথর। ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট আনা হয়েছে ছয় কন্টেইনারে। এছাড়া কাচশিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ আনা হয়েছে ১০ কন্টেইনারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড়, রং ইত্যাদি রয়েছে ২৮ কন্টেইনারে। একটি কন্টেইনারে রয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ। পরে ৩২৮ টিইইউএস পণ্য নিয়ে আসা জাহাজটি ১২ নভেম্বর বন্দর ছেড়ে গিয়েছিল।
গত শনিবার দিবাগত রাতে জাহাজটি দ্বিতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ১১৩ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে জাহাজটি প্রথমে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে পৌঁছে। ওখান থেকে ৭১২ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে জাহাজটি গত ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পথ ধরে।
আমদানিকারকদের ভাষ্য, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চলে আসছে অনেক আগে থেকে। তবে এতদিন দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো জাহাজ চলাচল ছিল না। ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হয়ে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে জাহাজ ধরার বিষয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের উদ্বেগের বড় কারণ ছিল। ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে চার দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত পণ্য আটকা পড়ে থাকার ঘটনা ঘটত। এতে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতির কবলে পড়তে হতো।
সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় এখন করাচি থেকে কোনো কন্টেনার বোঝাই করা হলে তা চট্টগ্রামে নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছার এবং চট্টগ্রাম থেকে ফিরতি পথেও নির্ধারিত সময়ে করাচি পৌঁছা নিশ্চিত হওয়ায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অস্বস্তি কেটে গেছে। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ বা ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য একটি নতুন সোর্স তৈরি হলো; যা প্রতিযোগিতামূলক দরে পণ্য আমদানির ক্ষেত্র প্রসারিত করবে।
পানামার পতাকাবাহী ১৮২ মিটার দৈর্ঘ এবং ৩০ মিটার প্রস্থের ৮.১ মিটার ড্রাফটের জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজেন্সি লাইনস লিমিটেড। গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা বলেন, দুবাইভিত্তিক কন্টেনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ফিডার লাইনস ডিএমসিসি এমভি ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং জাহাজ দিয়ে দুবাই থেকে পাকিস্তান হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন রুট তৈরি করে সেবা প্রদান শুরু করে।
তারা দুবাই, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মুন্দ্রা বন্দরকে এই রুটে সংযুক্ত রেখেছে। মুন্দ্রা বন্দর থেকে পণ্য নিতে হলে জাহাজটির এক ভয়েজে ৪২ দিন সময় লাগবে। ভারতের পণ্য না থাকলে সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাত-করাচি-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করলে প্রতি ভয়েজে সময় লাগবে ৩৮ দিন। এক্ষেত্রে অপর একটি জাহাজ বহরে যুক্ত হলে প্রতি ২০ দিনেই এক ভয়েজ স¤পন্ন হবে।
আনিস উদ দৌলা আরও বলেন, করাচি-চট্টগ্রাম জাহাজ চলাচল ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীরা আরো খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাদের অতীতের ভোগান্তি এই একটি জাহাজ চলাচলের মাধ্যমে দূর হয়েছে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করে সময়মতো হাতে পাওয়ার যে অনিশ্চয়তা ছিল সেটি কেটে গেছে। আমাদের প্রিন্সিপ্যালের সাথে কথা হয়েছে। পণ্য আমদানি বাড়লে এই রুটে তারা দ্বিতীয় জাহাজের চলাচল শুররু করবে। তাতে আরো কম সময়ে করাচি-চট্টগ্রাম রুটে পণ্য আনা নেওয়া সম্ভব হবে। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ আরো সাশ্রয় হবে। তবে পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় ব্যাপক আলোচনা হয়। দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে অনেকে বিষয়টি নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।
করাচি-চট্টগ্রামে সরাসরি জাহাজযাত্রাকে দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ বলে আখ্যায়িত করেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্য শুরু হওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি প্রতিবেশি দেশ ভারত। দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম প্রতিবেশীর মধ্যে এই নতুন সংযোগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা খুবই নিন্দনীয়।