
রমজানের ঈদেও যে আদা খুচরা কেজিপ্রতি ১১০-১২০ টাকা বিক্রি করা হয়েছিল, সেই আদা ঈদ শেষ হওয়ার ১০ দিন পর বিক্রয় করা হচ্ছে ২৮০ টাকায়। আর ওই আদা হচ্ছে ভারত থেকে আমদানি করা। তখন চীন থেকে আদা আমদানি বন্ধ ছিল ডলার সংকটের কারণে।
আর ঈদের পরে চীন থেকে আমদানি করা আদার কেজিও বিক্রয় করা হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৬০ টাকা দরে। হঠাৎ আদার দাম আড়াই গুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাট-বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, এতে তাদের কোন হাত নেই। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরাই আদা নিয়ে দাদাগীরি শুরু করে দিয়েছে।
নগরীর চকবাজারের তাহের এন্ড সন্সের মালিক ইমরুল করিম ও বহদ্দারহাটের হাটহাজারী স্টোরের মালিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আদার সংকট দেখিয়ে পাইকারি হিসেবে প্রতিকেজি ভারতীয় আদা ২৬০ টাকায় দরে বিক্রয় করছে। ফলে পরিবহন খরচসহ খুচরায় ২৮০ টাকা দরে বিক্রয় করছি আমরা।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, ভারতীয় আদা এখন শেষ পর্যায়ে, এ কারণে হয়তো চড়া দামে বিক্রয় করছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বর্তমানে চীন থেকে আদা আমদানি হচ্ছে। আর ওই আদা প্রতিকেজি পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে ৩৪০ টাকা দরে। যা খুচরা পর্যায়ে ৩৬০ টাকা দরে বিক্রয় করা হচ্ছে। আদার এই দাম অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান তারা।
অভিযোগের বিষয় যাচাই করতে সোমবার (১৫ মে) সকালে খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন আড়তদারের সাথে কথা হয়। এরমধ্যে বাণিজ্য ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী ও আমদানিকারক মনজুর মোরশেদ বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা আদা প্রায় শেষের পথে। তবে মিয়ানমার ও চীন থেকে আদা আসছে। যা অতিরিক্ত বুকিং রেট দিয়ে কিনতে হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এই অবস্থা হয়েছে। ফলে দেশেও আদার দাম বাড়ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আসা আদা পাইকারিতে কেজিপ্রতি ২৬০ টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে। আর চীন থেকে আমদানি করা আদা কেজিপ্রতি ৩৪০ টাকা দরে পাইকারি হিসেবে বিক্রয় করা হচ্ছে। ঈদের পর বাজারে আদার চাহিদা বাড়ায় এবং আমদানি কম হওয়ায় বাজারে আদার দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি।
খাতুনগঞ্জ কাঁচাপণ্য আড়তদার সমিতির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, অনেক দিন ধরেই বাজারে চীনা আদা নেই। ঈদের পর চীন থেকে মাত্র এক কনটেইনার আদা চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে খাতুনগঞ্জে আসার পর কেজি ৩৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে গেছে। আর বাজারে থাকা মিয়ানমারের আদা ২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১২০-১৪০ টাকা।
তিনি বলেন, বর্তমানে সাগরে দুটি জাহাজে চীন থেকে কয়েক কনটেইনার আদা এসেছে। সেগুলো আস্তে আস্তে খালাস হচ্ছে। কিন্তু বুকিং রেট বেশি হওয়ায় এসব আদার দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং আসন্ন কোরবানির ঈদে আদার দাম আরো বাড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা কোরবানিকে সামনে রেখে এসব আদা আমদানি করেছে।
অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে আদার কোন সংকট দেখছি না। টাকা দিলেই মিলছে আদা। দাম নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হচ্ছে-আদার সংকটের কথা। বিশ্ববাজারে আদাসহ সব ধরণের মসল্লার দাম বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। যা একটি অজুহাত বলে মনে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজীর দেউরি বাজারের শাহ আমানত স্টোরে নিত্যপণ্য কিনতে আসা ক্রেতা জানে আলম রাশেদ বলেন, রমজানের ঈদে আমি একসঙ্গে দুইকেজি ভারতীয় আদা কিনেছিলাম। প্রতিকেজি আদা দাম নিয়েছিল ১২০ টাকা দরে। সেই আদা শেষ হয়ে যাওয়ায় আদা কিনতে এসেছি। কিন্তু দাম শুনে আমি হতবাক। প্রতিকেজি আদা নাকি এখন ২৮০ টাকা। আর চীনা আদা বলছে ৩৬০ টাকা। কিন্তু বাজারে আদার কোন কমতি দেখছি না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে অন্য যে কোন নিত্যপণ্যের মতো আদার দামও বাড়িয়ে বিক্রয় করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, বাজারে শুধু আদার দাম বাড়ছে, তা তো না। সব জিনিসের দামই বাড়ছে। সরকার তো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ নজরদারি না থাকায় বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছেন ভোক্তারাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক নাসিরুদ্দিন বলেন, ঈদুল আজহার প্রস্তুতি, আমদানি, ঋণপত্র কেমন হবে তা নিয়ে মে মাসে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে রয়েছে। এ জন্য ট্যারিফ কমিশন তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা বাজার তদারকি শুরু করব।
ট্যারিফ কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বছরে তিন লাখ টন আদার চাহিদা রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন আদার উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৮২ হাজার টন। বাকি আদার চাহিদা মেটানো হচ্ছে আমদানি করে। মিয়ানমার, ভারত ও চীন থেকে আদা আমদানি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তবে রমজানের ঈদের আগে চীন থেকে আদা আমদানি বন্ধ থাকায় খাতুনগঞ্জের বাজারে মসলাটির দাম বাড়তির দিকে রয়েছে।
বাজারে আদার দাম বৃদ্ধি স¤পর্কে জানতে চাইলে অ্যাগ্রো কমোডিটি ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রেজাউল করিম আজাদ বলেন, চীনের আদার চাহিদা দেশে বেশি। কিন্তু সেখানে বুকিং ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে এখন টনপ্রতি দুই হাজার ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই দামেও তাঁরা বুকিং নিয়ে পরে বাতিল করছেন। ফলে বিপদে পড়তে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সমস্যা নিরসনের উপায় হিসেবে বিকল্প দেশের খোঁজ করছি আমরা। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে বেশ কয়েকটি কনটেইনার আদা। আর ভিয়েতনাম থেকেও আসছে আদা। এই অস্থিরতা দেখেই আমিও বুকিং বন্ধ রেখেছি। বাজার দেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।