সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্যাস পাওয়া যায় না। আসে রাত ১১টার পরে। দিনভর গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বলে না। জোটে না খাবার। এমনকি চা পর্যন্ত খাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে তো আর জীবন চলে না। বউ-বাচ্চার কষ্ঠ আর সহ্য হচ্ছে না। বাধ্য হইয়া কারেন্টের (ইলেক্ট্রিক) চুলা কিনেছি।
এমন সব কথা-বার্তা বলছিলেন চট্টগ্রামের চকবাজার ওয়ালটন শো রুমে ইলেক্ট্রিক চুলা কিনতে আসা মরজিনা আক্তার। নগরীর চকবাজার থানা গলির পেছনে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। ওই শোরুমে কিছুক্ষণ থাকতে আরও বেশ কয়েকজন আসেন চুলা কেনার জন্য। সবার একই অভিযোগ— দিনের বেলা একদম গ্যাস থাকে না। মাস দুয়েক ধরে এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। কিছু এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস থাকলেও চাপ খুবই কম।
শুধু ওই চকবাজার এলাকায় নয়। পুরোপুরি শীত আসার আগেই চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকাতে এই গ্যাস সংকট তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে চান্দগাঁও ফরিদের পাড়া, সমশের পাড়া, মোহাম্মদ পুর, খাজা রোড, মোহরা এলাকায়ও গ্যাস সংকট যেন নিয়মিত সমস্যা।
এসব এলাকার অধিকাংশ ভুক্তভোগীর ভাষ্য, সকাল ৬টায়ও ঘুম থেকে বিকেল ৩-৪টা পর্যন্ত ঠিকমতো গ্যাস থাকে না। রাতে রান্না করে রাখা খাবার যে পরদিন সকাল ও দুপুরে গরম করব সেই উপায়ও নেই অনেক এলাকায়। আবার সন্ধ্যা ৬টার থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস মিলে না। ফলে অনেকেই ইলেক্ট্রিক চুলা ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ রান্না করছেন কেরোসিনের চুলায়। এতে বাড়তি খরচের চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট এলাকার একটি মেসে থাকেন শিক্ষার্থী নজরুল। তিনি বলেন, দিনের বেলা একদমই গ্যাস থকে না। খুব ভোরে বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আগে বুয়া না আসলে আমরা নিজেরা রান্না করে খেতাম। কিন্তু এখন বুয়া মাঝেমধ্যে না আসলে কোনো উপায় থাকে না। সারাদিন বাইরে থেকে কিনে খাওয়া লাগে। এতে খরচও অনেক বেশি পড়ে যায়।
নগরীর চান্দগাও থানার পূর্ব ফরিদের পাড়া এলাকার বাড়িওয়ালা সুলতান আহমেদ বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই সকালে গ্যাস চলে যাচ্ছে। আসে একেবারে রাতে। আমরা বাড়িওয়লারা মিলে কয়েকদিন ধরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (কেজিডিসিএল) অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতেছি, কিন্তু কোনো সুরাহা মিলছে না।
ইকবাল হোসেন নামে একজন তার ফেসবুক ওয়ালে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখেছেন, আমি সমশের পাড় এলাকায় থাকি। অনেক বছর ধরে সকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। রাত ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা গ্যাস দিয়ে কার বা- ছিড়বে জনগণ। মাস শেষে ১০৮০/- ফাও বিল দিচ্ছি৷ পাশাপাশি সিলিন্ডার+ইলেক্ট্রিক চুলার বিলও দিচ্ছি।
তিনি আরও লিখেছেন, আমি কিছু দেশে দেখেছি কোনো লাইনের গ্যাস নাই। সব সিলিন্ডার গ্যাস। গ্যাস না দিলে এই লাইনের গ্যাস কেন রাখা হচ্ছে? জনগণের সাথে এসব প্রতারণা বাদ দিয়ে হয় লাইনের গ্যাস দিন, প্রয়োজনে মিটার সিস্টেম করুন। আর সবচেয়ে উত্তম হয় লাইন গ্যাস চিরতরে বাদ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ সিলিন্ডারের আওতায় নিয়ে আসুন। শুধু সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ১০০০ টাকার মধ্যে রাখুন।
বেড়েছে ইলেক্ট্রিক চুলার কদর :
বর্তমানে বাজারে নানা ধরনের ইলেক্ট্রিক চুলা পাওয়া যায়। তম্মধ্যে গ্রাহকদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে ইনফ্রারেড ও ইনডাকশন চুলা। ইনফ্রারেড চুলায় সব ধরনের পাতিল ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে ইনডাকশন চুলায় নির্দিষ্ট কিছু পাতিল ব্যবহার করা যায়। দুই ধরনের চুলাই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। দাম তিন হাজার থেকে শুরু ৫-৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই দুই ধরনের চুলা ছাড়াও বিক্রি হচ্ছে রাইস কুকার, কাড়ি কুকার, ইলেক্ট্রিক কেটলি। এমনকি ওভেনের চাহিদা বেড়েছে।
চট্টগ্রাম শপিং সেন্টারের একটি শোরুমের ম্যানেজার ফাহিম বলেন, শীত আসলে এমনিতেই এসব জিনিসের চাহিদা বাড়ে। কারণ শীতের সময় গ্যাস কম থাকে। এবার মোটামুটি ভালোই চাহিদা রয়েছে। শুনতেছি আশপাশের বেশকিছু এলাকায় নাকি গ্যাস থাকতেছে না। এজন্য মানুষ বেশি কিনছে। তিনি আরও জানান, এ বছর মানুষ ইনফ্রারেড ও ইনডাকশন চুলা বেশি খুঁজছে। গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে শুধু আবাসিক নয়, গ্যাস সংকট চলছে কারখানাগুলোতেও। বন্ধ রাখতে হচ্ছে শিফট। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। সঠিক সময় উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি। কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেজিডিসিএল এর মহাব্যবস্থাপক গৌতম কুন্ডু বলেন, শীতের সময় কিছুটা গ্যাস সংকট থাকে। শীতকালে চাহিদা বেশি থাকে। গ্যাস সরবরাহ কম থাকলেও একেবারে থাকে না এই ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছে আসে না। যদি কোনো এলাকায় এই ধরনের সমস্যা হয় তবে আমাদেরকে জানালে আমরা সমস্যা সমাধান করব।
এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে সবসময়ই ব্যাপক ফারাক থাকে। দেশে স্বাভাবিক গ্যাসের যে চাহিদা তাতে অন্তত চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। এখন বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি, দেশের গ্যাস— সব মিলিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ডিসেম্বর মাসে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমতে পারে। এতদিন সাড়ে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে নেটওয়ার্কে সরবরাহ করা হতো।
এছাড়া সার কারখানা বন্ধ ছিল। ফলে প্রাপ্ত গ্যাসের প্রায় পুরোটাই শিল্পকারখানায় সরবরাহ করা হতো। এখন সার কারখানা চালু হওয়ায় সেখানে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে এলএনজি টার্মিনালে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘটফুট। তাই গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঈশান/সুপি/মউ