- ইউরোপ আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, পালিয়ে আসার পর হাছান মাহমুদ বেলজিয়াম থেকে একাধিকবার দিল্লিতে অবস্থানরত দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি আসতে চেয়েও অনুমতি পাননি।
জার্মানিতে আওয়ামী লীগের সভায় নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হওয়ার পরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) বেলা ২টায় জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে জার্মান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রতিবাদ সভা ও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে এই ঘটনা ঘটে। সভায় টেলিকনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন সদ্য ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
সভায় ভারতের দিল্লিতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ফোনে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। পরে নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার কাছে দিকনির্দেশনা চাইলে পাল্টা প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, পড়ে পড়ে আর মার খাওয়া যাবে না, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হবে, মুক্ত করতে হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর হক খান এবং সঞ্চালনা করেন জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া ও সহসভাপতি নুরজাহান খান নুরী। নেতাকর্মীরা জানান, সভাস্থলে পৌঁছার পর হাছান মাহমুদ কুশলবিনিময় করার একপর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
কয়েকজন নেতা বলেন, আপনি বেলজিয়াম থেকে জার্মানিতে কেন এসেছেন? এখানে আপনার কাজ কী? আপনার মতো কয়েকজন নেতার কারণে আওয়ামী লীগের আজকে এই দুরাবস্থা। আওয়ামী লীগকে আপনারাই ডুবিয়েছেন। আপনি এখানে কোনো কথা বলবেন না। চুপচাপ গিয়ে মঞ্চে বসে থাকুন।
আরেক নেতা হাছান মাহমুদের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, আপনাদের লোভ আর দুর্নীতির কারণেই দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আজকে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে সবার জীবন। আহত নিহত নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর আপনি রাখেন নাই। যাকে ইচ্ছা তাকে দলে ঢুকিয়েছেন। দলের শুভাকাঙ্খিদের নির্যাতন করেছেন। আপনাদের দুর্নীতির কারণে দল আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়লেও হাছান মাহমুদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি চুপচাপ ছিলেন। পরে জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর হক খাঁন এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে হাছান মাহমুদকে সরিয়ে এনে বিশেষ অতিথিদের টেবিলে বসান। অনুষ্ঠানে বাকি পুরোটা সময় হাছান মাহমুদ সেই চেয়ারেই বসে থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনেন। সভা শেষে জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি নীরবেই সভাস্থল ছেড়ে চলে যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বলেন, সম্ভাব্য জনরোষ এড়াতে সমাবেশ উপলক্ষে প্রচারিত পোস্টারে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের নাম রাখা হয়নি। গত আগস্ট থেকে তিনি বেলজিয়ামের নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও এই প্রথম জনসমক্ষে আসেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়াও বিপুল টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
ইউরোপ আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, পালিয়ে আসার পর হাছান মাহমুদ বেলজিয়াম থেকে একাধিকবার দিল্লিতে অবস্থানরত দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি আসতে চেয়েও অনুমতি পাননি।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছেছেন।
সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।বেলজিয়ামে তিনি লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে ৪ আগস্ট রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ ছাড়েন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকেন। এদিকে আটক হওয়ার পর হাছান মাহমুদ কিভাবে বাংলাদেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন— এ নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের দিকে প্রথম বেলজিয়াম যান হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি বেলজিয়ামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ও লিম্বুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও করেছেন। সেখানে তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবেই থাকেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়।
পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। এরপরও শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।