স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। তার যোগ্য সহযোগী ছিলেন স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী। স্বামী-স্ত্রী দু‘জনে মিলে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিতে দু‘জনই যেন মানিকজোড়।
সরকারি টিআর, কাবিখা, সৌরবাতি ও গভীর নলকূপ স্থাপনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে নদভীর বিরুদ্ধে। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের সংঘবদ্ধ চক্র। গ্যাং সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি ও অপরাধে লিপ্ত ছিল। ২০১৯ সালে এমপি থাকাকালীন উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের গাটিয়াডেঙ্গা এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ব্রিজের নির্মাণকাজ পরিদর্শনে যান নদভী। এ সময় জসিম উদ্দিন নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ কর্মী নির্মাণকাজের অনিয়ম তুলে ধরলে উত্তেজিত হয়ে তাকে জোরে থাপ্পড় মারেন নদভী।
ওই সময় উপস্থিত কয়েকজন ব্যক্তি নদভীকে শান্ত করার চেষ্টা করলে নদভী উল্টো তাদের ধাক্কা দেন। উত্তেজিত নদভী সেসময় জসিম উদ্দিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাকে চিনস নাই, বেয়াদব। আমি এখানে কেন এসেছি, কলা খেতে এসেছি? আমি যা করতে পারব সেটা তোরা করতে পারবি, তাই না? ফালতু কোথাকার। আমি কতটা রাগী সেটা জানিস না? একেবারে জীবিত পুঁতে ফেলব।’ এ ছাড়া গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনি লাশ ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। যার অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) টাওয়ারের অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে নদভী দম্পতির বিরুদ্ধে। ১৫ তলাবিশিষ্ট ওই টাওয়ার আইআইইউসির ট্রাস্টভুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের অর্থ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করার সুযোগ নেই। কিন্তু মাসিক সম্মানী, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা, জ্বালানি এমনকি মোবাইল ফোনের টাকাসহ নয়ছয় হয়েছে নদভী দম্পতির নেতৃত্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন খাত থেকে অন্তত ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে জানা গেছে।
আইআইইউসির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আজাদী দুর্নীতির অনুসন্ধান চলার কথা উল্লেখ করে বলেন, দুদক যেসময় যেসব কাগজপত্র চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ তদন্তও হচ্ছে। তদন্তে বেশকিছু অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
এছাড়া লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী সোনাকানিয়া ইউনিয়নের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন বড়হাতিয়া বনের প্রায় ২৫০০ একর সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমি দখল করে দুই পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি কৃত্রিম হ্রদ। ন্যাচারাল লেক নাম দিয়ে সেখানে মাছ চাষ শুরু করেন। তার পিএস চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য এরফানুল করিম চৌধুরী ওই লেকটির তদারকি করতেন। বাঁধ দিয়ে লেক বানানোর কারণে সেচের অভাবে স্থানীয় শত শত কৃষকের চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নদভীর পরাজয়ের পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লেকটির বাঁধ কেটে দিয়ে বনভূমিটি উদ্ধার করে বন বিভাগ।
নদভী নিজের অনুসারী এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করলেও মূল্যায়ন করেছেন তার আত্মীয়-স্বজনদের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রী ও পিএস থেকে শুরু করে ভাইপো এবং শ্যালককে পর্যন্ত বসিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে। আগে কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলেও ২০১৭ সালে হঠাৎ করে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্যের পদ বাগিয়ে নেন নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী। নদভীর পিএস এরফানুল করিম চৌধুরীকে বসিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্যের চেয়ারে। ভাইপো আ ন ম সেলিম চৌধুরীকে বানিয়েছেন মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীকে বানান চরতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এ কারণে স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও ছিলেন তার ওপর ক্ষুব্ধ।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় নদভী নিজের নামে ৫০ ভরি এবং তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর নামে দেখান ১০ ভরি সোনা। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় নদভীর স্বর্ণালংকার বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ ভরি ও স্ত্রীর নামে দেখানো হয় ৫০ ভরি। অন্যদিকে ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০১৮-২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে নদভী ও তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৩ গুণ।
সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল মোস্তাক বলেন, ‘নদভী অতীতে কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি মাদার্শা ও সোনাকানিয়া ইউনিয়নের বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর সবচাইতে বেশি স্টিমরোলার চালিয়েছেন। নিরীহ মানুষকেও ঘুমাতে দেননি। বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করেছেন। সরকারি প্রকল্প থেকে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা মিলে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ তার গ্রেপ্তারে খুশি। তারা নদভীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।’
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত নদভীর দুর্নীতির তদন্ত করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক টাওয়ার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী জেলে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তার স্ত্রীও আত্নগোপনে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। এমনকি ফোনও রিসিভি করেননি।