
দেশজুড়ে বোরো আবাদের ভরা মৌসুম চলছে। বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটারের বেশি পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু বোরো উৎপাদনে সেচবাবদ নয় হাজার ৮৭ কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হয়। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। দেশের কৃষকদের সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হয়। ধান উৎপাদনে এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ।
পানির অপর নাম জীবন। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগরর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন।
বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ন্ন বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোন কোন বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মিলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। দেশে বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ও ডিজেল চালিত ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তুলে। এগুলো ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে অনেক এলাকায় মাটির ৩০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ।
পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তসলিম উল করিম বলেন, দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের সেচ পাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৩০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি ধান উৎপাদনে এক হাজার ৫০০শ’ থেকে এক হাজার ৭০০শ’ লিটার পানির প্রয়োজন হয় প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে। কৃষকরাও ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির হিসেবে, বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে ২১ লাখ ৭৯ হাজার ৭০টি। এর মধ্যে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদ্যুতে চলে মাত্র ২ লাখ ৮ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে ১ লাখ ৮৭ হাজার। ডিজেলে চলে ১৪ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ৩২ হাজার ডিজেলে এবং ২৯ হাজার বিদ্যুতে চলে। বোরো মৌসুমে প্রায় ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে।
কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা। সে সঙ্গে পানির উৎস্য তৈরি করতে হবে। নদী-নালা খনন ও বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানি কম লাগে এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। পানি কম লাগে আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনে সরকারকে জোর দিতে হবে। এ দুটি ফসল উৎপাদন খরচ কম। বৃষ্টির পানিতে আবাদ করা যায়।
বিশ্বব্যাকের কৃষি বিষযক পরামর্শক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। সেচ পাম্পের মাধ্যমে সেচের পানি তুলতে গিয়ে চাপ পড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর। হাজার কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানি অত্যন্ত দ্ষ্প্রুাপ্য। গ্রীষ্মের শুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সঙ্কটে ব্যাহত হয় জনজীবন। ক্রমেই পানি সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে বরেন্দ্র অঞ্চল। রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ও নওগ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিয়দংশ এলাকা জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। সুপেয় খাবার পানি নিয়ে সংঘাতে প্রাণহানিও হয়েছে একাধিকবার। পানি না পেয়ে এলাকা ছাড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ।
পানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ সেচের পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সারাদেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি ওঠেছে নাভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরী হয়েছে।
ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত হানছে। ফলে লবণাক্তত বেড়ে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার।
খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় সুপেয় পানি প্রায় দুষ্পাপ্য। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। এসব অঞ্চলে ধান চাষে কৃষকের উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ’ অনুযায়ী- গত কয়েক বছরে দেশের ৪৩ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে সেচের পানি সংকট। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। মহুরি সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়।
বিশ্বব্যাংকের পানি বিষয়ক গবেষক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যেই গলে যাবে হিন্দুুকুশ ও হিমালয় পবর্তমালার বরফ। দুই পবর্তমালার হিমবাহগুলো অন্তত আটটি দেশের পানির প্রধান উৎস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহ গলে গেলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এ অঞ্চলের দুইশো কোটিরও বেশি মানুষ। কেউ কেউ আগামী দিনে পানি নিয়ে বিশ্ব যুদ্ধের আশংকাও করছেন।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০২০ সালেই বিশ্বের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ পানির স্বল্পতার শিকার হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান ও ভুট্টার ফলন দশ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে ইতিমধ্যে শস্যের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে গেছে। – তথ্যানুসন্ধানে: আলতাব হোসেন।
ঈশান/খম/বেবি