চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনায় ফের ভাবমুর্তি সংকটের মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। চলতি বছর এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় জেটি ও বহির্নোঙরে ছয়টি জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জাহাজে তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
অথচ ২০২১ সালেও চট্টগ্রাম বন্দর এমন দস্যুতা বা পাইরেসিমুক্ত ছিল। এতে বেশ স্বস্তিতে ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবহারকারীরা। দস্যুতামুক্ত থাকায় বিশ্বের শিপিং সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরে সংঘটিত চুরি-ডাকাতির ঘটনা বাড়ায় হোঁচট খেল সেই সাফল্য।
এর আগে ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যূরোর (আইএমবি) এক প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরকে জলদস্যু আক্রমণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দর ঘোষণা করে। ওই বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিল ৪৭টি। একের পর এক দস্যুতার ঘটনায় ওই সময়ে পৃথিবীজুড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছিল।
এর ফলে অনিরাপদ মনে করে বিদেশি জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানাত। আর যেসব জাহাজ পণ্য নিয়ে বন্দর জলসীমায় পৌঁছাত, তারাও সারচার্জ বা বাড়তি মাসুল আরোপ করত। ফলে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে খরচ লাগত বেশি।
কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড যৌথ প্রচেষ্টায় একটি কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগের পরই দস্যুতামুক্ত হতে শুরু করে বন্দরের জলসীমা। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমুর্তি কিছুটা উজ্জল হয়ে উঠে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঘটিত চুরি-ডাকাতির ঘটনা চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমুর্তি ফের বিনষ্ট হওয়ার পথে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
দস্যুতা বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। তবে এ পরিস্থিতিতে জেটি ও সাগরে অবস্থানরত জাহাজে নজরদারি আরও বাড়াতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ জন্য বন্দরের একটি সেল থেকে ওয়াচম্যান বা পাহারাদার জাহাজে নিয়োগ দেওয়ার জন্য শিপিং এজেন্টদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে শিপিং এজেন্টরা খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা বলে তাতে আপত্তি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ায় আমদানি-রপ্তানি পণ্যের জাহাজের সংখ্যা নিয়মিত বাড়ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে এসব জাহাজে পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া দরকার। এ জন্যই শিপিং এজেন্টদের বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে শিপিং এজেন্টদের কাছে পাঠানো চিঠিতে চুরি-ডাকাতির এই ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
বন্দরের চিঠিতে চুরি-ডাকাতির তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটলে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য বন্দরে আগত জাহাজে বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়াচম্যান বুকিং সেল থেকে ওয়াচম্যান নিয়োগের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বন্দরের সেল থেকে ওয়াচম্যান নিয়োগ দিলে প্রতিটি জাহাজের জন্য প্রতিদিন খরচ হবে ৮৯ থেকে ১০৮ ডলার। কোনো জাহাজ যদি ১৫ দিন বা এক মাস বহির্নোঙরে থাকে, তাহলে তার খরচ হবে দেড় থেকে তিন লাখ টাকা। যা সহজ বিষয় নয়।
তবে বন্দর যদি নিরাপত্তা জোরদার করতে চায়, তাহলে সেটা নিজস্ব কর্মী দিয়ে করুক। প্রজ্ঞাপন জারি করে মাশুল আদায় করলেও আপত্তি নেই আমাদের। কিন্তু এভাবে বন্দরের ওয়াচম্যান সেল থেকে দিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
বন্দরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে অবস্থানরত ছয়টি জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এমভি জাফর হানিফ, ২৪ মে এমটি সাকসেস, ৭ জুন এনসিসি মেসিলা, ৮ জুন টিম ফোকাস এবং ৪ জুলাই এমটি ওরিয়ন এক্সপ্রেস ও মেলিনা জাহাজে চুরি-ডাকাতি হয়।
বাণিজ্যিক জাহাজে সংগঠিত সশস্ত্র ডাকাতি, দস্যুতা ও চুরি প্রতিরোধে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংগঠন রিক্যাপ প্রকাশিত রিপোর্টেও চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় জাহাজে সংঘটিত দস্যুতার ঘটনার রেকর্ড করা হয়েছে। রিক্যাপ রিপোর্টে ২০২২ সালের জানুয়ারি-এপ্রিলে সংঘটিত তিনিট ডাকাতির ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে বন্দর জলসীমার কুতুবদিয়া এলাকার সাগরে গত বছর ১৫ মার্চ ওয়াসান টোপাজ ট্যাংকার জাহাজ, ১৬ এপ্রিল বিএলপিজি সোফিয়া এলপিজি ট্যাংকার জাহাজ এবং ২৬ এপ্রিল এসটিআই ম্যাজিস্টার ট্যাংকার জাহাজে পাইরেসির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে তিনটি ঘটনা শুধু চুরির উদ্দেশ্যেই ঘটেছে। তিনটি ঘটনায় রশি, রং ও তার চুরি হয়েছে। কোস্ট গার্ড টিম দ্রুত সেগুলো উদ্ধারও করেছে। আর এসব ঘটনায় জাহাজের কোনো ক্যাপ্টেন-ক্রু আহত হয়নি, জাহাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে রিপোর্টে বলা হয়।
উল্লেখ্য, আমদানি পণ্যের কোনো কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় পৌছার পর দস্যুদের কবলে পড়ে। দস্যুরা এসব জাহাজ থেকে রশি. রং ও তারসহ নানা উপকরণ চুরি করে। এছাড়া জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল, সয়বিন তেলসহ নানারকম ভোগ্য পণ্য ডাকাতি করে। তবে এসব দস্যুদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চালায় কোস্টগার্ড। উদ্ধার করে চুরি ও ডাকাতি করা পণ্য-মালামাল। আটক করে দস্যুদের। এরপরও থামছে না জাহাজে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা।