নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের (সিটিভি) অর্থ লুটে খাচ্ছে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নূর আনোয়ার হোসেন। ভুয়া অনুষ্ঠান শিডিউল তৈরির মাধ্যমে ভুয়া বিলে অর্থ লোপাট, বিধি বহির্ভূত নিয়োগ বাণিজ্য, উপকরণ কেনাকাটা, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্য তাঁর নিত্যনৈমত্তিক বিষয়।
যার মাধ্যমে তিনি সিটিভি থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লোপাট করছেন। এ জন্য তিনি সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ড. হাসান মাহমুদকে ম্যানেজ করতেন। এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থের পাশাপাশি তিনি সিটিভির সুন্দরী উপস্থাপিকাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন। তিনি নিজেও নারীঘটিত নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন।
এ বিষয়ে সিটিভির একজন নারী শিল্পী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জিএম নূর আনোয়ার হোসেন তো সবসময় মডেল ও চট্টগ্রামের সুন্দরী কিছু উপস্থাপিকা ও শিল্পীদের নিয়ে মহানন্দে থাকেন। যাদের দিয়ে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতাপশালী সাবেক দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টার আশীর্বাদ নিয়ে প্রচন্ড ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন তিনি। ফলে কেউ এসবের দিখে ফিরেও থাকাতেন না। তিনি আবার এসবের ধারও ধারেন না।
আরেকটি সূত্র জানায়, জিএম নূর আনোয়ার হোসেন এর নারীঘটিত বিষয় ওপেন সিক্রেট। এসব বিষয়ে আলোচনা সমালোচনায় তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না। এ বিষয়ে তার নিজস্ব সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেটের মধ্যে প্রযোজক ইয়াদ আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিথি প্রযোজক সাখাওয়াত হোসেন মিঠু এবং বৈদ্যনাথ অধিকারীর নাম উঠে এসেছে।
শুধু তাই নয়, সিটিভিতে ১৮ জন মেধাবি প্রযোজক থাকার পরও বিগত সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক অযোগ্য অতিথি প্রযোজকদের দিয়ে অধিকাংশ প্রোগ্রাম সম্পন্ন করান তিনি। যাদের দ্বারা একটি আলোচনার অনুষ্ঠানেরও বাজেট দেয়া হয় এক লাখ টাকার উপরে। যা অতীতে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে কখনোই হয়নি।
অথচ বিটিভির নিজস্ব প্রযোজকরা প্রোগ্রাম না থাকায় অলস সময় পার করেন। অপরদিকে অন্যান্য শাখায় তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সুপারিশে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারিদের হুমকি প্রদান করা প্রায় ৩০ জন কর্মচারি এখনো বহাল তবিয়তে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারিরা হলেন, গালিব চৌধুরী, রাকিবুল হাসান, পলাশ আচার্য, প্রকাশ বড়ুয়া, তানজিনা চৌধুরী, মো. নেজাম উদ্দিন, ছবি আক্তার, সৈয়দ মো. কুদ্দুস আমেরী, মো. ইমরান হোসেন চৌধুরী, তাহমিনা জিন্নাত, প্রবীর বড়ুয়া, আতিকুর রহমান, ইমরুল হায়দার সুমন, কাজী রাকিবুল হাসান, মো. ওয়াহেদ নেওয়াজ, রাজু রুদ্র, আশীষ পাল।
আর চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী প্রয়োজকরা হলেন- এডভোকেট ইফতেখার সাইমুম এর ভাই শেখ শওকত ইকবাল চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ এর নাতি সাখাওয়াত হোসেন মিঠু, ইসকন সদস্য বৈদ্যনাথ অধিকারী, চবির সাবেক ভিসির মেয়ে রিফাত মোস্তফা, হাসানুল হক ইনুর মেয়ে আফরোজা দিনা প্রমুখ। যাদের নামে প্রতিদিন ভুয়া অনুষ্ঠানের বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
তথ্যমতে, ‘বদলে গেছে বাংলাদেশ’ নামক একটি অনুষ্ঠানের প্রযোজক সাখাওয়াত হোসেন মিঠু। সেও একজন চুক্তিভিত্তিক অতিথি প্রযোজক। এই অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরা। অথচ এ প্রোগ্রামে ছিল না কোন অংশগ্রহণকারি। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে প্রোগ্রামগুলো ধারণ করার কথা থাকলেও যাদের সাথে কথা বলা হয় তাদেরকে দেওয়া হয়নি কোন চেক। এই অতিথি প্রযোজকদের স্বাক্ষর করার ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও নিজেরা বিল বানিয়ে লাখ লাখ টাকার চেক উত্তোলন করা হয়!
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই অনুষ্ঠানগুলোতে যাদের নামে চেক দেখানো হয়েছে এরা প্রকৃতপক্ষে অংশগ্রহণকারি কেউ নয়। এগুলো জিএম তার লোকদের নামে এসব চেকগুলো দিয়ে নিজেরাই ভোগ করে। এই প্রোগ্রামটি প্রতিনিয়ত প্রচার হলেও প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠান নির্মাণ হয় না। শুধু অংশবিশেষ পরিবর্তন করে প্রচার করা হয় আর নতুনভাবে বিল তৈরি করা হয়।
এক শিল্পী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও এসব কর্মচারি ও অতিথি প্রযোজকরা কিভাবে টিভি ভবনে প্রবেশ করে এটাই খুঁজে পাই না। কারণ তারা যেভাবে বিগত সরকারের দাপট দেখিয়েছে তাদের নিজে থেকেই আসা উচিত নয়। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রামের শিল্পীরা যেকোনো সময় অনুষ্ঠান বর্জন তথা আন্দোলনে নামবে বলে আমি মনে করি।
আরেক শিল্পী বলেন, জিএম নূর আনোয়ার হোসেন এসব কর্মচারিদের নিয়ে তার নিজস্ব (?) বাহিনী গঠন করে দাম্ভিকতার সাথে অপরাধ কর্ম করে যাচ্ছেন। তাদের অত্যাচারে কেন্দ্রের কর্মকর্তারাও অসহায় বোধ করেন। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিটিভির ১৪ জন কর্মকর্তা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর প্রেরিত পদায়ন এবং পদোন্নতি বাতিলের জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেন। যা গত ৯ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে বিটিভির মহাপরিচালকের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়।
এ ঘটনায় বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম ওই কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালককে (প্রশাসন) হুমকি দেন মুঠোফোনে। যার একটি অডিও ক্লিপ এই প্রতিবেদকের হাতে রক্ষিত রয়েছে। অডিও ক্লিপে শোনা যায়, আক্তার সাহেব আপনি মনে হয় আমাকে বয়েট করছেন। তার উত্তরে যখন বলা হয়, আপনি আমাকে না বলে ফাইল তুলেছেন- এটা কেন করলেন। উত্তরে নূর আনোয়ার হোসেন বলেন-এই কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে? অবশ্যই দিতে হবে স্যার-এ কথা বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে নূর আনোয়ার হোসেন বলেন-এই শুয়োরের বাচ্চা, লাত্থি দিয়ে তোকে বিদায় করে দেবো।
অপরদিকে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম নুর আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনসহ জীবনের হুমকির বিষয় তুলে ধরে জিডি করার জন্যে অনুমতি চেয়ে মহা পরিচালক বরাবরে আবেদন করেন এই কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) মো. আতাউর রহমান।
তিনি উল্লেখ করেন, বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম অত্যন্ত ধূর্ত ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী লোক। এখানে তার সঙ্গে বিভিন্ন খারাপ শ্রেণির লোকের নিবিড় সখ্যতা রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সাধারণ জীবন যাপন করায় বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাইরে কোন লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নাই। এমতাবস্থায় আমার জীবনের হুমকি বিবেচনা করে জিএম নুর আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে জেনারেল ডায়েরি করার অনুমতি প্রার্থনা করছি।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারিরা জানান, নুর আনোয়ার হোসেন মূলত বাংলাদেশ টেলিভিশনের অডিয়েন্স রিসার্চ অফিসার/স্ক্রিপ্ট এন্ড মনিটরিং এডিটর (গ্রেড টু) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এর সুপারিশ ক্রমে তাকে বিধি বহির্ভূতভাবে স্থায়ী পদ প্রযোজক (গ্রেড-২) পদায়ন এবং পদোন্নতি করা হয়। বিটিভির ইতিহাসে এমন অনিয়ম এটিই একমাত্র এবং প্রথমও।
এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ১৪ জন কর্মকর্তা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর প্রেরিত পদায়ন ও পদোন্নতি বাতিলের জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেন। যা গত ৯ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের একান্ত কাছের ব্যক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নূর আনোয়ার হোসেন বিটিভিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি ভোল পাল্টে বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রের জিএম হিসেবে যোগদানের জন্য নিজেকে পরিবর্তনসহ তদবিরে উঠে পড়ে লেগেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তবর্তিকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের দৃষ্টি কাড়ার কুটচাল হিসেবে ইদানিং তিনি হাটহাজারীর বিশিষ্টজনদেরকে নিয়ে প্রোগ্রামের আয়োজন শুরু করেছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর আত্নীয় পরিচয়ধারী দু‘একজনকে এরই মধ্যে সিটিভি কেন্দ্রে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচাল ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের দাপ্তরিক ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। তবে মহাপরিচালকের দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ বিষয়ে গত ৩০ মে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত প্রশাসনিক সতর্কীকরণমূলক একটি চিঠি বিটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেটা দেখলে আপনি বিষয়টা বুঝতে পারবেন।
ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সিটিভির জিএম নূর আনোয়ার হোসেন বরাবরে প্রেরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, আপনি গত ২৯ মে মাসিক সমন্বয় সভার নির্ধারিত আলোচ্যসূচির উপর আলোচনা ও সিদ্ধান্তের পরও নির্ধারিত আলোচনায় অভদ্রোচিতভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্নক ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। আপনাকে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হয় তা সত্বেও আপনি সভাপতির অনুরোধ উপেক্ষা করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে ব্যক্তিগত আক্রোশ মূলক বক্তব্য রাখতে থাকেন।
এমনকি সভা শেষে আপনি বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা বলেন। আপনার পদমর্যাদা ও দায়িত্ব বিবেচনায় একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এমন আচরণ স¤পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেও প্রতিয়মান হয়েছে। এমন আচরণ সরকারি কর্মচারি আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯ এর লঙ্ঘন এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ২ এর অসদাচরণের দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
চাকুরীর শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ ও কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য আপনাকে শেষবারের মতো প্রশাসনিকভাবে সতর্ক করা হলো। অন্যথায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে আপনার বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে এর প্রতিফলন ঘটবে।
এদিকে সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য সিটিভির জিএম নূর আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনেও একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি একবারও ফোন ধরেননি।