বৃহস্পতিবার- ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

বিপদের গন্ধ পেয়ে আখের গোছাতে শুরু করে এস আলম!

এস আলম নামে এই সাইফুল আলম মাসুদ হচ্ছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বাবা ও শেখ হাসিনার চাচা খ্যাত প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ভাগ্নে। এক সময় এই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুই ছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার। কিন্তু তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই শিল্প গ্রুপ দখল করেন সাইফুল আলম মাসুদ। এ নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করলেও হতাশা আর দুশ্চিন্তায় মারা যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।

বিপদের গন্ধ পেয়ে আখের গোছাতে শুরু করে এস আলম!
print news
  • কারখানাগুলো ছিল অর্থ হাতানোর হাতিয়ার

  • ম্যানেজ করত রাজনীতিক-সাংবাদিকও
  • বাস্তবে না হলেও বড় গ্রুপ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা
  • ‘ঋণ মওকুফ করাতে’ বারবার অগ্নিকাণ্ড

ট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ বলা হয় এস আলম গ্রুপকে। আসলে তা নয়, চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা অঞ্চলেও রয়েছে এই গ্রুপের শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে এই শিল্প গ্রুপকে যতবড় করে দেখা হয়, তা কিন্তু আসলে নয়। এর পেছনে কারিগর ছিলেন দেশের কতিপয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সাংবাদিক। যাদের ম্যানেজ করতেন গ্রুপটির কর্ণধার এস আলম খ্যাত সাইফুল আলম মাসুদ।

মূলত চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এই গ্রুপের শিল্প কারখানা রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি। গ্রুপটির তথ্যমতে, এই শিল্প-কারখানার সংখ্যা সবেমাত্র ৯টি। আর হাতেগোনা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ঘিরে অর্থ হাতানোর জাল পেতেছেন সর্বত্র। বিশেষ করে ব্যাংক ও বিমা খাত থেকে ঋণ হিসেবে হাতিয়েছেন শত থেকে হাজার কোটি টাকা।

ঋণ পেতে নিজের করে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানও। ব্যাংকগুলো হলো- ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। দখল করেছেন দেশের স্বনামধন্য ইসলামী ব্যাংকও।

এ কাজে পুরোপুরি ক্ষমতা খাটিয়েছেন ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার। ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ ও সালমান এফ রহমানের মতো কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও। যারা মোটা অঙ্কের সুবিধা নিয়ে চোখ বন্ধ করে এই সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নেতাদের সাথেও তলে তলে সখ্য ছিল সাইফুল আলম মাসুদের। যাদের আন্দোলন সংগ্রামে কাড়ি কাড়ি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। যাকে ধূর্ত হিসেবে চিনে চট্টগ্রামের সচেতন মহল।

সচেতন মহলের ভাষ্য, দেশের দুই প্রভাবশালী দলের নেতাদের সাথে সখ্য থাকার কারণে সাইফুল আলম মাসুদ সহজে পেয়ে যেতেন দেশের ভালো-মন্দ আগাম খবর। সে হিসেবে ৫ আগস্টের বিপদের গন্ধও তার নাকে পৌঁছে যায় অনেক আগেই। সেই থেকে শুরু হয় নিজের আখের গোছানোর নানা পরিকল্পনা।

একদিকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কারখানা ও নিজের নামে, ছেলেসহ পরিবারের নামে, এমনকি নিজ এলাকা পটিয়া থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামেও অবাধে শত থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন সাইফুল আলম মাসুদ।

এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবহার করে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকসহ সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি ঋণ নিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারাও লোভে পড়ে সব ধরনের অনিয়মে সহযোগিতা করেন। তারাও শত কোটি থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে আরাম আয়েশে দিনযাপন করছেন।

এসব ঋণের খেলাপি হিসেবে বর্তমানে এস আলম গ্রুপকে দায়ী করা হলেও এর পেছনে নেপথ্যে কারিগররাও দায়ী। যাদের নাম এখনো পর্যন্ত কোনো স্তরে উঠে আসেনি। আর ঋণের এসব অর্থ তছরুপ করতে কম কৌশল করেননি সাইফুল আলম মাসুদ। এর মধ্যে একের পর এক কারখানায় আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার পরিকল্পনা ছিল, আগুনের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে একদিকে ব্যাংক ঋণ মওকুফ পাওয়া, অন্যদিকে বিমা সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি ৮০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ মওকুফও পেয়েছেন। আবেদন করেছেন বিমা সুবিধার জন্যও।

আগুনের ঘটনাগুলো ছিল যেমন

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ৪ মার্চ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা এলাকায় অবস্থিত এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। প্রায় ৬ দিন পর ৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আগুন সম্পূর্ণ নেভানো সম্ভব হয় বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। আগুন লাগা গুদামটিতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনির মজুদ ছিল। আগুন নেভানোর পর প্রায় ৮০ শতাংশ চিনি রক্ষা করা সম্ভব হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

এর আগে ১ মার্চ বেলা ১১টার দিকে বাকলিয়া থানাধীন সৈয়দ শাহ রোডের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কার্যালয়ের পাশে এস আলম গ্রুপের তাজা মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড হিমাগারে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি স্টেশনের ১০টি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনে। এই অগ্নিকাণ্ডে কেউ হতাহত না হলেও হিমাগারটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখানো হয়। অথচ হিমাগারটি ছিল নির্মাণাধীন।

সবশেষ গত ১২ এপ্রিল এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড নামে ভোজ্যতেলের মিলের একটি গুদামে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যে গুদামটিতে আগুন লেগেছে ওই ভবনের মাত্র ১০ ফুট দূরত্বেই ছিল তেলের মজুদ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, তেলে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা নেভানো কঠিন হতো। শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক এসব তথ্য যোগান দিয়েছেন।

এস আলমের ঘনিষ্ঠজনের প্রতিক্রিয়া

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জারটেক এলাকার বাসিন্দা ও এস আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত নুরুল আলম বলেন, একের পর এক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কারখানাগুলোতেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এসব আগুনের ঘটনাগুলো স্বাভাবিক নাকি অন্য কোনো হেতু আছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ এই এস আলম গ্রুপ আগা গোড়াই একটি জালিয়াত ও মারোয়ারি গ্রুপ।

নুরুল আলম বলেন, এস আলম নামে এই সাইফুল আলম মাসুদ হচ্ছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বাবা ও শেখ হাসিনার চাচা খ্যাত প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ভাগ্নে। এক সময় এই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুই ছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার। কিন্তু তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই শিল্প গ্রুপ দখল করেন সাইফুল আলম মাসুদ। এ নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করলেও হতাশা আর দুশ্চিন্তায় মারা যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।

এরপর এস আলম গ্রুপ বনে যায় দেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপ প্রতিষ্ঠান। যা আসলে নয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মিলে এই গ্রুপের শিল্প কারখানা রয়েছে ৯টির মতো। এর মধ্যে চট্টগ্রামে থাকা ৬টি শিল্প কারখানার তিনটিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এস আলম গ্রুপের ৮০০ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, অত বড় না হলেও এই শিল্প গ্রুপকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বড় শিল্প গ্রুপ হিসেবে দেখানো হতো। এর পেছনে ছিলেন দেশের কতিপয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সাংবাদিক। নিজের কুকর্ম চাপা দিতে এদের ম্যানেজ করে চলত, বলতে গেলে পুষতেন। এস আলম গ্রুপের টাকায় চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক রাজনীতিক ও সাংবাদিক এখন শত কোটি টাকার মালিক। মালিক একাধিক গণমাধ্যমেরও। যারা এখন এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন।

তবে বেইমানি করেননি রাজনীতিকরা। তাদের সহযোগিতায় গত বছর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান সাইফুল আলম মাসুদ। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এস আলম গ্রুপ একাই এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য ফাঁস করেন।

যেভাবে হাতিয়েছেন ব্যাংক ঋণ

দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে একের পর এক ফাঁস হচ্ছে সাইফুল আলম মাসুদ ও তার দুই ছেলেসহ পরিবারের বিভিন্নজনের নামে-বেনামে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে শত থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য। এর মধ্যে তোলপাড় চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে পৌনে চার হাজার কোটি ও ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি।

২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক মাহফুজুল হক স্বাক্ষরিত বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংক হালিশহর শাখা থেকে চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জে মেসার্স স্টার কেয়ার ট্রেডিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে চার হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা এখন সুদসমেত ১৬ হাজার ৭৬৪ কোটি ১০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।

একইভাবে চকবাজার সিরাজদ্দৌলা রোডের মেসার্স আইডিয়াল প্রিন্টিং হাউজ নামে এক ছাপাখানার নামে ইসলামী ব্যাংক জুবিলী রোড শাখা থেকে ১৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ওই শাখা থেকে ওই ছাপাখানার নামে ফের ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। যা সুদসমেত ৮৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা পাওনা দেখানো হয়েছে।

একইভাবে চট্টগ্রামের বালুছড়া কুলগাঁও এলাকায় বায়েজিদ ড্রেসেস প্রা. লি. ডিলার হাউস-৩ নামক একটি গার্মেন্টস অ্যান্ড ফ্যাক্টরির নামে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ দেখানো হয়েছে। যা সুদসমেত পাওনা ১৮৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই।

ওই প্রতিবেদনসংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ও বকেয়া স্তিতির মধ্যে বড় পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সন্দেহজনক। তাই প্রকৃত অবস্থা জানার নিমিত্তে পরিদর্শক দল গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ পরিদর্শন টিমের এই চিঠি ও প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পৌঁছেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে তা নকল কপি। যা মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত প্রতিবেদন আয়নাঘরে চলে গেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের তথ্যমতে, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের কাছে জনতা ব্যাংক এক হাজার ৭৭৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা পাবে। এই ঋণের বিপরীতে ঢাকার গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজার ৬৮৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুর সদরে রয়েছে ২০১ শতাংশ জমি। আর এ ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে এস আলম গ্রুপের ১৮৬০ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৩৫৮ কোটি টাকা। এ দাম পাওনা টাকার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ কম।

অন্যদিকে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে দুই হাজার তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এই ঋণের বিপরীতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও গাজীপুরের শ্রীপুর মিলিয়ে দুই হাজার ৯৭১ দশমিক ২৭ শতাংশ জমি বন্ধক রয়েছে ব্যাংকের কাছে। যার মধ্যে গাজীপুরে রয়েছে ২৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমি।

সব মিলিয়ে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুটি কোম্পানির কাছে জনতা ব্যাংকের মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি। বছরের পর বছর এই পাওনা পরিশোধ না করায় অর্থঋণ আদালতের আইন অনুযায়ী নিলাম ডাকে চট্টগ্রামে জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন শাখা।

এ দুটি কোম্পানির ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করতে ২৩ জানুয়ারি নিলামের তারিখ রেখে ব্যাংকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। কারখানা দুটির মধ্যে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। গত ৮ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জনতা ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবে গ্রুপের লিগ্যাল বিভাগ।

এসব নিয়ে সিঙ্গাপুরে সরব রয়েছেন সাইফুল আলম মাসুদ। হুমকি দিচ্ছেন নিলামের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা মনে করি এই ধরনের টেন্ডার নোটিশের কারণে আমাদের ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে উক্ত ব্যাংকের এই টেন্ডার নোটিশের জন্য, আমরা এখন উক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার পথে রয়েছি। উক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমাদের আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রয়োজন অনুযায়ী আপনাদের অবহিত করা হবে।

দুশ্চিন্তায় সাইফুল আলম মাসুদ

দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নিয়ে সে দেশে বসবাস করলেও অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে সাইফুল আলম মাসুদ চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, দেশ থেকে লাখ কোটি টাকা পাচার করেও বসে নেই সাইফুল আলম মাসুদ। শিল্প কারখানাগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে আরও অর্থ পাচারের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। শিল্প কারখানাগুলোতে কর্মরত কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ কাজে সহযোগিতায় তৎপর রয়েছেন। এ কাজের অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ গ্রুপের ৬টি কারখানা বন্ধও ঘোষণা করা হয় বলে দাবি কর্মকর্তাদের।

বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে চিনি প্রক্রিয়াজাত কারখানা এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্পাতের পাত প্রক্রিয়াজাত কারখানা এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস ও ইনফিনিটি সি আর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢেউটিনসহ ইস্পাতপণ্য তৈরির কারখানা এস আলম স্টিল, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস নফ, চেমন ইস্পাত ও গ্যালকো স্টিল এবং ব্যাগ তৈরির কারখানা এস আলম ব্যাগ লিমিটেড।

এর মধ্যে ঢাকাভিত্তিক গ্যালকো স্টিল ছাড়া বাকি সব কারখানা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার কালারপুল ও ইছানগরে কর্ণফুলী নদীর পাড় মইজ্জারটেক এবং বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়ন এলাকায় অবস্থিত।

শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া

পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে যখন নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেশের মানুষ, ঠিক সেই মুহূর্তে ২৪ ডিসেম্বর দুপুরে এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে নোটিশ জারি করে ৬টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণার নোটিশ দেখে শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা অভিযোগ করেন, আকস্মিক নোটিশের ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা গভীর সংকটে পড়েছেন। পরে শ্রমিকদের চাপের মুখে এক সপ্তাহ পর বন্ধ কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের শ্রমিক আমজাদ হোসেন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বন্ধের সময় আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। কাজ করতে না পারলে তো পেটে খাবার জুটবে না। এখন কারখানা খুলে দেওয়ায় আমি এবং আমার সহকর্মীরা খুব খুশি।

তিনিসহ কয়েকজন শ্রমিক বলেন, এস আলম গ্রুপ কী করেছে, সেটার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীরা দায়ী নয়। সেটার জন্য সরকার দায়ী। সরকার এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নিক, কারখানাগুলো যেন বন্ধ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ কারখানাগুলো দেশের সম্পদ।

এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের উৎপাদন ব্যবস্থাপক নাজিম উদ্দীন বলেন, ব্যাংকের ঋণ সহায়তা না পাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছিল না। তাই সাময়িকভাবে কারখানাগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। কারখানাগুলোর উৎপাদন কিভাবে ঠিক রাখা যায় এখন আমাদের নজর সেদিকে।

এস আলমের পক্ষে সাফাই ও বিজ্ঞজনের ভাষ্য

কারখানায় আগুন ও বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের জিএম (প্রশাসন) মো. হোসাইন রানা বলেন, শিল্প কারখানার ব্যাংক ঋণ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কারণ ব্যাংক ঋণ ছাড়া কারখানার কাচামাল আমদানি সম্ভব নয়। তাই বলে কারখানায় আগুন দিয়ে বা কারখানা বন্ধ করে সুবিধে আদায়ের বিষয়টি ঠিক নয়।

জিএম বলেন, কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাও স্বাভাবিক। আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতা কিংবা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ছিল না। অজান্তেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেছে। হয়ত গরমের কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। এতে মালিকপক্ষের দোষ কী?

এ বিষয়ে জানতে কথা হয় সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও টিআইবি চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এস আলম গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপের কারখানায় আগুন ও কারখানা বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্ত পুরো শিল্পখাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এটি বাংলাদেশের শিল্পনীতি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সরকারের উচিত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো এবং এস আলম গ্রুপের আর্থিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা তদন্ত করা। যাতে এমন সংকট ভবিষ্যতে আর না ঘটে।

ঈশান/খম/বেবি

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়