রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে এসিওএস পদে কর্মরত মো. শরীফ উদ্দিন। অফিসিয়ালি তিনি কর্মকর্তা হলেও আন অফিসিয়ালি বিশাল চোর চক্রের গডফাদার তিনি। যাদের মাধ্যমে মাফিয়া স্টাইলে নানা কৌশলে রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম চুরি করে বাইরে পাচার করেন। আত্নসাৎ করেন কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম।
এরমধ্যে সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের আড়ালে বিল ভাউচার করে সরকারি অর্থ আত্নসাৎ করার কাজে লিপ্ত তারই অনুসারি একটি ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ার্স টিম। অপর একটি টিম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন ডিপো থেকে যন্ত্রাংশ চুরি করে। আরেকটি টিম প্রকৃত ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে মালামাল সরবরাহের সময় মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদাবাজি করে।
যারা বিগত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ পরিচয়ে এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব চোরচক্র কয়েকদিন গা ঢাকা দিলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠে। এর মুলে রয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন।
কারণ সরকার পতনের পর তিনিও অসুস্থতার কথা বলে দীর্ঘ একমাস নিজ কর্মস্থল পাহাড়তলী প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকে ফের সক্রিয় হয়ে উঠে চোর চক্র।
২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এসব তথ্য জানান ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ার্সরা। তাদের ভাষ্য, এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে যোগদানের পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করে। সেই থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী নিয়ে বিশাল বাহিনী গড়ে তোলে। যারা মাফিয়্ াস্টাইলে নানা কায়দায় সরকারি অর্থ আত্নসাৎ ও সম্পদ চুরি করে রেলের সর্বনাশ করেছে।
ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়াররা জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে তিনস্তরের চোরাই সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এরমধ্যে একটি হচ্ছে কেনাকাটার সরঞ্জাম সরবরাহে চাঁদাবাজ চক্র। যার সর্দার দুই যুবলীগ নেতা। তাদের বাড়ি কুমিল্লায়। থাকেন রেলওয়ে পাহাড়তলী স্টেশনের কলোনীতে।
আরেকটি চোরচক্র হচ্ছে স্ক্র্যাপ বা যন্ত্রাংশ চোর চক্র। যার সর্দার আরেক যুবলীগ নেতা। তার বাড়িও কুমিল্লায়। অপর চোর চক্র হচ্ছে সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে মালামাল সরবরাহ না করেই ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে বিল তুলে আত্নসাৎ করা। যার সর্দার এমইএস কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে এক ঠিকাদার।
সূত্র জানায়, গত তিন-চার বছর ধরে এসিওএস শরীফ উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে রেলের লোকোমোটিভ সরঞ্জাম, স্টেশনারী সরঞ্জাম কেনাকাটা হয়। এ নিয়ে কন্টাক্ট চুক্তি করেন তিনি। যা করতে গিয়ে তিনি প্রথমত বাজারদর থেকে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এরপর সরবরাহকারীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের কমিশন। এছাড়া বহু ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া বিল দেখিয়ে রেলের বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা আত্নসাৎ করেছেন।
যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এমইএস কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নামধারী ওই ঠিকাদার। যা সঠিকভাবে অডিট বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা হলে অব্যশই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানে, ভুয়া বিল উত্তোলনের কয়েকটি ডকুমেন্ট এই প্রতিবেদকের হাতেও রয়েছে।
এছাড়া গত কয়েকবছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি ডিপোতে তেল, র্স্ক্র্যাপ ও যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা ঘটে। যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এসিওএস শরীফ উদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট এক যুবলীগ নেতার চোরচক্র। যিনি সার্বক্ষণিক রেলওয়ে পাহাড়তলী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে বীরদর্পে বিচরণ করতেন। সেখান থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপো থেকে তেল, র্স্ক্র্যাপ ও যন্ত্রাংশ চুরি পরিচালনা করতেন।
এরমধ্যে চলতি বছরের ৩ জুন রাতে রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির (আরটিএ) মডেল রুমে চুরির ঘটনা ঘটে। মডেল রুমে থাকা পিতলের রেললাইন, র্ট্র্যাক সার্কিটে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার (সুপার অ্যানামেল কপার ওয়্যার), পয়েন্ট মেশিনের রডসহ অন্তত ২০-২৫ লাখ টাকার বিভিন্ন দামি সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে এই চক্রের এক সদস্য।
একইভাবে চলতি বছরের জুনে বন্দরের সিজিপিওয়াইতে (গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) নতুন গাড়ি পরিবহনের জন্য আনা প্রায় ৫ লাখ টাকার লোহা চুরির ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ২৩ মে পাহাড়তলী লোকোশেড থেকে ভুয়া ভাউচারে ট্রাকভর্তি স্লিপার ও রাবার চুরি করে বিক্রি করতে গেলে পুলিশের হাতে চালক ও হেলপার ধরা পড়ে সাগরিকা মোড়ে। ওই ঘটনার পর কোনো তদন্ত হয়নি। এর কিছুদিন পর ইঞ্জিনের ৬টি ব্রাশ বার (দামি তামার তার) চুরি হয়।
এছাড়া লোহা ও যন্ত্রাংশ মিলে ৩ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয় মে মাসেই। গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শুরুতেও ২০০০ সিরিজের একটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরির ঘটনা ঘটে এ ইয়ার্ডে। যেটির আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকা থেকে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর টুল ভ্যানের প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে।
এছাড়া ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা তিনটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরি হয় সিজিপিওয়াই থেকে। কবে চুরি হয়েছে সেটি রেলওয়ে জানতে না পারলেও ৯ জুলাই বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় আরএনবির পক্ষ থেকে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করে।
এছাড়া চট্টগ্রামে তেলবাহী ওয়াগন ও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকেও প্রতিদিনই চুরি হয় তেল। সিজিপিওয়াই থেকে তেলবাহী ওয়াগন বের হলে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার পথেই চুরি করা হয় তেল। একইসঙ্গে পণ্যবাহী ট্রেন থেকে তেল চুরি করা হয় ফেনীর শর্শদী স্টেশনে থামিয়ে।
এমন একটি তেল চুরির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের টাইগারপাসের মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে রেলের বগি (কোচ) পরিষ্কার শেষে রেল স্টেশনে আনার পথে। ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ দুপুরে মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি পরিষ্কার শেষে স্টেশন আনার পর ৩০ লিটারের এক গ্যালন মবিলসহ ধরা খায় চোরচক্রের এক সদস্য। পরে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তখন বগিটি ইয়ার্ড থেকে আনার পথে কদমতলী এলাকার ফ্লাইওভারের নিচে (কোচ নম্বর ৬৩০৭) এই রকম আরও ছয় গ্যালন মবিল নামিয়ে নেয় বলে জানা গেছে।
এছাড়া ফেনীর শর্শদী স্টেশনে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার লিটার তেল চুরি হয়। ট্রেনটি এ স্টেশনে প্রায় ২০ মিনিট বিরতি দেয়। চুরি হওয়া এসব তেলের বাজার মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা, মাসে যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৪ লাখ টাকা।
এভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগে গত এক বছরে প্রায় চার কোটি টাকার স¤পদ চুরির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়েছে। দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে কর্তৃপক্ষ পার পেলেও উদ্ধার হয়নি রেলের কোনো চুরি যাওয়া জিনিস ও টাকা। চুরির এসব ঘটনায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান জহিরুল ইসলামের সম্প্রতি শাস্তিমূলক বদলি হলেও প্রকৃত অপরাধী মো. শরীফ উদ্দিন চোর চক্রের কোন সাজা হয়নি।
যুবলীগ নেতার আরেকটি চক্র সক্রিয় চাঁদাবাজিতে। যারা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে অবস্থান করতেন। সরঞ্জাম কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে এসব চোর চক্রের ছিল দারুণ সখ্যতা। যারা সরঞ্জাম কেনাকাটার মালামাল সরবরাহ দেওয়ার সময় দাবিকৃত চাঁদা না দিয়ে গেইটের ভেতরে প্রবেশ করতে পারত না।
সম্প্রতি রিপণ নামে এক ঠিকাদার বলেন, সরঞ্জাম কার্যালয়ের ইনেসপেকশন বিভাগের ফার্নিসার সরবরাহ করার সময় গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েকদিন আগে আমাকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। যুবলীগ নেতা পরিচয়ে এই টাকা নেওয়া হলেও এর সিংহভাগ চলে যায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে এসিওএস পদে কর্মরত মো. শরীফ উদ্দিনের পকেটে।
এভাবে চোর চক্র গড়ে তুলে এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন রেলওয়ে পাহাড়াতলী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়সহ পুরো রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলকে চোরের খনিতে পরিণত করেছেন। চুরির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অপরাধীরা পারও পেয়ে যায়। অনেক সময় রাস্তার ভবঘুরে ও টোকাইদের আসামি করে দায়সারা রিপোর্টও দেওয়া হয়। ফলে আসল অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। মেসেজ অপশনে বার্তা লিখে পাঠালেও তিনি কোনরকম সাড়া দেননি। একইভাবে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের প্রধান মো. ফরিদ উদ্দিনও কল রিসিভ না করায় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, নিরাপদ ও সাশ্রয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও দুর্নীতির কারণে রেলখাত পিছিয়ে যাচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত। জবাবদিহিতা না থাকায় দূর্নীতি ও চুরি বন্ধ হচ্ছে না। দূর্নীতি ও চুরি বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় শাস্তির ব্যবস্থাও।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইং, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে এসিওএস শরীফের ঘুষ বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন ও সিসিএস মো. ফরিদ উদ্দিনের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। আর এই প্রতিবেদনে সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে।