
সাংবাদিক জিগারুল ইসলাম জিগার। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাধারণ মানুষের জন্য যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। রাঙ্গুনিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের বিশ্বস্ত ক্যাশিয়ার ছিলেন তিনি। এ সুবাধে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে সচিবালয়-মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দুর্দন্ড প্রতাপ ছিল তার। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গ্রুপ থেকে প্রতিদিন কোটি টাকা হাতিয়ে উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতেন মন্ত্রীর কাছে। বলা যায়, গুণধর মন্ত্রীর গুণধর ক্যাশিয়ার।
মন্ত্রীও সন্তুষ্ট হয়ে শুনতেন তার কথা। এতে রাঙ্গুনিয়া থেকে চট্টগ্রাম মহানগর পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। রাতারাতি হয়ে উঠেন কোটিপতি। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণের রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি থেকে হয়ে যান বাসসের স্টাফ রিপোর্টার। সেটাও ছিল ড. হাছান মাহমুদের খুশির দান। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী থাকাকালে নানা ছলা-কলাকৌশলে বাসসের স্টাফ রিপোর্টার বানিয়ে দেওয়া হয় রাঙ্গুনিয়া উপজলার চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবীয়া মাদ্রাসা থেকে কোনোমতে আলিম পাশ করা এই জিগারুল ইসলাম জিগারকে। জানা গেছে, তখন ডিগ্রীর সনদ দিয়েই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় বাসসে। কারণ ডিগ্রী পরীক্ষার সনদ ছাড়া বাসসে নিয়োগের কোন সুযোগ নেই।
একইভাবে নিজ স্ত্রী মালেকা আক্তারের জন্যও ভাগিয়ে নেন চাকরি। ২০১২ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকাকালে ড. হাছান মাহমুদের দয়ায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা বনগ্রাম রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোল শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মালেকা আক্তার। এভাবে হাছান মাহমুদের হাত দিয়ে নানা অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন সাংবাদিক জিগার। এদিকে সাংবাদিকের স্ত্রী হিসেবে কম দাপট ছিল না মালেকা আক্তারেরও। শিক্ষকতার চাকুরি পাওয়ার পর স্বামীর ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দিন দিন ভাগ্যের ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটনা মালেকাও।
সহপাঠি শিক্ষকদের তথ্যমতে, কথায় কথায় স্বামীর দোহাই দিয়ে ইচ্ছামত স্কুলে আসতেন আর যেতেন পোল শিক্ষিকা মালেকা। কোন কোন সময় অনুপস্থিত থাকতেন কোন কারণ ছাড়াই। উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্তা ব্যাক্তিরাও তার ভয়ে তটস্থ ছিল, কেউ মুখ খুলার সাহস পেতেন না।
সহকারি শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানায়, শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধি সংক্রান্ত আইন মোতাবেক পোল শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সুনিদিষ্ট গাইড লাইন বিধান রয়েছে। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম যেন ব্যহত না হয়, সেজন্য পোল শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার আনুপাতিক হার বিবেচনায় এ ধরনের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। রাঙ্গুনিয়া প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির সুপারিশকৃত, শুন্যপদের বিপরীতে মালেকা আক্তার ৫ম পোল সহকারী শিক্ষিক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়। বিগত ২০১২ সালের ৩০ মে রাঙ্গুনিয়া বনগ্রাম বেসরকারি রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন মালেকা। ২০১৩ সালে সারাদেশের মত এই স্কুলটি জাতীয়করণের অধিভূক্ত হলে যোগদানের ৭ মাসের মাথায় উক্ত শিক্ষকের ভাগ্য খুলে যায়।
টানা ১০ বছর বনগ্রাম বেসরকারি রেজিষ্টার্ড তথা বর্তমান বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ২০২৩ সালের ১৮ মে এই শিক্ষিকাকে হঠাৎ অবমুক্ত দেখানো হয়। এরপর স্মারক নং ৩৮.০১.০০০০.১৪৫.১৯.০০৫.২৩-৩৮২/২ তারিখ ৩০/০৪/২০২৩খ্রিঃ মুলে চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। যা সরকারি চাকুরি ও নিয়োগ বিধির লঙ্ঘন। বেআইনি পন্থায় এই শিক্ষিকাকে অবমুক্ত ও সংযুক্তিকরণ সম্পূর্ণ আইন বিরোধী বলে মনে করছেন শিক্ষক সমাজ। তারা মনে করেন ডেপুটেশন বা সংযুক্তি করণ ৬ মাসের বেশি হবার কথা নয়। কিন্তু এই শিক্ষিকা দুই বছরের অধিক সময় হলেও তাকে এখনো কর্মস্থলে ফিরে আনা হয়নি। ফলে বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
এলাকাবাসী জানান, অত্র বিদ্যালয়ের মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিসকে বারবার শুন্যপদের বিপরীতে শিক্ষক চাওয়া হলেও দেয়া হয়নি। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে ২৪৬ জন ছাত্র-ছাত্রীর পাঠদান করছে। স্থানীয় অবিভাবকদের দাবী, বর্তমানে শিক্ষক শূন্যতার কারণে তাদের ছেলে মেয়েদের প্রকৃত শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ে ৮ শিক্ষক পদের বিপরীতে আছে মাত্র ৫ জন। শিক্ষিকা মালেকা আক্তারকে অবমুক্ত করা হলেও তার চলে যাওয়া পর শুন্যপদে অন্য কোন শিক্ষক নিয়োগ বা সেটেলমেন্ট করা হয়নি। যদিও এধরনের নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বদলি জেলার কথা দুরে থাক, খোদ উপজেলার ভিতরে এবং নিয়োগকৃত স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও বদলির বিধান নেই। কিন্তু এ ধরনের অনিয়মের পাকাহস্ত ক্ষমতাধর সাংবাদিক জিগারের স্ত্রী পরিচয়ে উপজেলার প্রতিটি দপ্তরে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাংবাদিক জিগার কথায় কথায় সকলকে ধমক দিতেন। বিভিন্ন অজুহাতে কামিয়েছেন অবৈধ উপায়ে শতকোটি টাকা। বিনা পরিশ্রমে অর্জন করেছেন পাহাড়সম সম্পদ। কেউ সাহস করে কিছু বলতে পারতেন না। তিনি শুধু স্থানীয় প্রশাসন নয়, এমনকি মন্ত্রণালয পর্যন্ত কাঁপিয়েছেন সমান তালে। হাছান মাহমুদের আর্শীবাদে ক্ষমতা প্রয়োগ করে শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) ঢাকা থেকে নিজ হাতে স্ত্রীর বদলির অর্ডার এনে নিজ স্বার্থ আদায় করে নেন।
ক্ষমতার বলে বিভাগীয় উপ-পরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা, চট্টগ্রাম ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার চট্টগ্রামকে দিয়ে পরিপত্র জারি করান। একই আদেশে আরও ৭ জনকে পরিপত্র জ্ঞাত করান। এই আদেশের কারণে আজ প্রায় ২ বছর ধরে এই শিক্ষকের পদটি শুন্য রয়েছে। তাই বলে কি! ক্ষমতার অপ-প্রয়োগ করা, কোন ব্যাক্তির জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সকল বিভাগ কিছুতেই দায় এড়াতে পারেনা। জরুরী ভিক্তিতে এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা ও যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন এলাকাবাসি।
এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হিন্দোল বারী জানায়, পুরো উপজেলায় আমার অনেক শিক্ষকের পদ শুন্য রয়েছে। তারপরও শিক্ষিকা মালেকা আক্তারকে সহকারী পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) প্রাথমিক শিক্ষা, অধিদপ্তর কেন অবমুক্তির আদেশ দিলেন তা আমার বোধগম্য নয়। অনেক শুন্যপদ থাকা সত্ত্বে রাঙ্গুনিয়া থেকে এভাবে শিক্ষক চলে গেলে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যহতে হবেই।
তিনি বলেন, স্মারক নং ৩৮.০১.০০০০.১৪৫.১৯.০০৫.২৩-৩৮২/২ তারিখ ৩০/০৪/২০২৩খ্রিঃ মুলে চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্তি করে বিগত ১৮/০৫/২০২৩ খ্রিঃ তারিখে অপরাহ্নের অবমুক্ত করতে হলো শিক্ষিকা মালেকা আক্তারকে। আমি তো উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করতে পারি না। আমাদের কাছ থেকে কোন প্রস্তাব যায়নি, আদেশ পাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র দিয়েছি। তাছাড়া এখানে করার কিছু ছিল না।
শিক্ষিকা মালেকা আক্তারকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।