শনিবার- ২২ মার্চ, ২০২৫

স্যালাইন সংকটে নাজুক চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবা

ছয়গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট

print news

বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যাপকহারে ব্যবহার হয় নরমাল স্যালাইন। এরমধ্যে ডেঙ্গুর ব্যাপকতায় এই স্যালাইনের ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্যালাইন সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে গায়ে লেখা নির্ধারিত দামের চেয়ে ছয়গুণ বেশি অর্থ।

ফলে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে চিকিৎসা সেবায় নাজুক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। নিত্য হাহাকার চলছে রোগী ও স্বজনদের। শনিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর স্ব্স্থ্যা সেবার শেষ ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতাল, শেভরণ ও সিএসসিআর হাসপাতালসহ বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসি ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, স্যালাইন নিয়ে এমন নাজুক পরিস্থিতি তৈরীর পেছনে বড় ধরণের সিন্ডিকেট রয়েছে। স্যালাইন উৎপাদনকারি কোম্পানি থেকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়ের দোকান এমনকি সবকটি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটে জড়িত।

বিভিন্ন স্তরের সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে মিলেছে এর সত্যতাও। শনিবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক হাসপাতালে কথা হয় মুনতাসির আলম নিশু (২৬) নামে এক রোগীর। ওইদিন হাসপাতালে করা করনস্কোপির রিপোর্ট নিতে আসেন তিনি।

তিনি বলেন, হাসপাতালের ৫ম তলার একটি কক্ষে প্রাইভেট চিকিৎসক ও চমেক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম আলী হায়দারের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক করনস্কোপি করায়। শুক্রবার সকালে এই পরীক্ষা করাতে গিয়ে স্যালাইন না পেয়ে বিপাকে পড়ি। পরীক্ষার জন্য ৫ আইটেমের ওষুধের সাথে আধা লিটারের এক ব্যাগ নরমাল স্যালাইন কিনতে বলা হয়। কিন্তু হাসপাতালের নিচ তলায় ফার্মেসিতে গিয়ে সব ওষুধ পেলেও স্যালাইন নেই বলে জানান।

নিশু বলেন, ফার্মেসির বিক্রেতা বলেন কোন ফার্মেসিতে স্যালাইন পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও ৪০০ টাকা দিতে হবে। আপনি বললে আমি খুঁজে দেখতে পারি। নিরুপায় হয়ে রাজি হলেও ওই ফার্মেসির বিক্রেতা কিছুক্ষণ পর বললেন স্যালাইন পাওয়া যায়নি। এতে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে ওই বিক্রেতা বলেন, আপনি যেখানে করনস্কোপি করাবেন সেখানে যান-নার্সদের বলুন। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। ওখানে ৪০০ টাকা দিলে নার্সরা স্যালাইন দিবে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল-নার্সরাই দিলেন স্যালাইন।

একইভাবে শনিবার বেলা ১১টার দিকে সিরাজ উদ্দিন (৩৪) নামে চমেক হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন বিভিন্ন ফার্মেসিতে ঘুরে ঘুরে স্যালাইন খুঁজতে দেখা যায়। কিন্তু সব ফার্মেসির বিক্রেতারা স্যালাইন নেই বলে জবাব দেন। একপর্যায়ে সাদা একটি চিরকুট নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সিরাজ উদ্দিন বলেন, মেঘনা ওষুধালয় নামে এক দোকানের বিক্রেতা একটি নাম্বার দিয়েছে। এটি চমেক হাসপাতালের নার্সদের দিলে নাকি স্যালাইন মিলবে। তবে ৪০০ টাকা দাম দিতে হবে। তাই সেখানে যাচ্ছি।

দুপুর ১২টার দিকে নগরীর ওষুধের পাইকারি বাজার খ্যাত হাজারি গলিতেও গিয়ে দেখা যায় একই দৃশ্য। সেখানেও শত শত মানুষ স্যালাইনের জন্য এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটাছুটি করছে। এ সময় কথা হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক শিশুর বাবা আনোয়ার হোসেনের (৩২) সাথে। তিনি বলেন, স্যালাইন কিনতে আসলে প্রথমে সবাই বলে নেই। কয়েকটি দোকান ঘুরার পর যে কোন এক বিক্রেতা স্যালাইন যোগাড় করে দেওয়ার কথা বলে ৪০০ টাকা দাবি করে। এতে রাজি হলে স্যালাইন মিলে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট হক মার্কেটের সামনে অবস্থিত ফার্মেসিগুলোতেও দেখা যায় স্যালাইনের জন্য ক্রেতার হাহাকার। এখানে ৪০০ টাকায়ও মিলছে না স্যালাইন। অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরির পর ৪৫০-৫০০ টাকায় কিনতে রাজি হলেই মিলছে স্যালাইন। অধিক দামে স্যালাইন কিনতে না পেরে ডেঙ্গু রোগীসহ বিভিন্ন সার্জারি, সিজার, ডায়ালাইসিসের রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হচ্ছে বলে জানান ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা।

ক্রেতারা জানান, এসব স্যালাইনের গায়ে কোস্পানির নির্ধারিত দাম লেখা আছে ৬৭ টাকা। কিন্তু স্যালাইন সংকটের পরিস্থিতি তৈরী করে বিক্রয় করা হচ্ছে ৪০০ টাকার উপরে। এভাবে ছয়গুণেরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে সুযোগ সন্ধানীরা। এসবের সাথে স্যালাইন উৎপাদনকারি কোম্পানি থেকে দোকানি এমনকি ডাক্তার-নার্সরাও জড়িত।

এ বিষয়ে কথা হয় বহদ্দারহাটের একটি ফার্মেসির মালিকের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, স্যালাইনের সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী উৎপাদনকারি কোম্পানিগুলো। এতে আমাদের কোন হাত নেই। কোম্পানি থেকে স্যালাইন সরবরাহ নেই বললেই চলে। আমরা ১০০ স্যালাইন অর্ডার দিলে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮-১০টি স্যালাইন। তাও আবার এসব স্যালাইনের সাথে ওরস্যালাইন না কিনলে মোটেও সরবরাহ করছে না। অথচ এসব কো¤পানির উৎপাদিত ওরস্যালাইনের কোন চাহিদাই বাজারে নেই। এগুলো বিক্রিও হয় না। বিক্রি হবে না জেনেও ওরস্যালাইন কিনে বাড়তি দরে সাধারণ স্যালাইন বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে ফার্মেসির মালিকরা। অনেক ফার্মেসির মালিক ওরস্যালাইন না কেনায় স্যালাইনের সংকট তৈরি হয়েছে।

নগরীর বেসরকারি পপুলার হাসপাতালের ফার্মেসির বিক্রয় কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, প্রচুর দামে স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে। একেবারে অনৈতিকভাবে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। গত কয়েকমাসে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব দেখারও যেন কেউ নেই।

তিনি বলেন, চাইলেই আমরা হাজারিগলি থেকে ৩৫০-৪০০ টাকায় স্যালাইন কিনে এনে ১০-২০ টাকা মুনাফায় বিক্রি করতে পারতাম। এতে আমাদের রোগীদের সুবিধা হতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলে বাড়তি দাম নেয়ার অভিযোগ আনা হবে আমাদের বিরুদ্ধে। এতে আমাদের হাসপাতালেরই সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। তাই আমরা স্যালাইন রাখছি না। কো¤পানি থেকেও আমাদেরকে স্যালাইন সরবরাহ একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। কিছু আসলেও সাথে সাথে তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্যালাইনের কোন স্টক নেই। পরিস্থিতি খুবই নাজুক বলে মত প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট একটি ওষুধ কো¤পানির চট্টগ্রামের এরিয়া ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা নির্দিষ্ট এবং আমরা স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন করতে পারছি। কিন্তু ডেঙ্গুর ব্যপকতার পর বাজারে চাহিদা বেড়ে গেছে ১০ গুনেরও বেশি। এতে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। ওষুধ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এই সুযোগ নিচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, চড়া দামে স্যালাইন বিক্রি করার পেছনে কো¤পানির কোন হাত নেই। আমরা নির্ধারিত দামে স্যালাইন সরবরাহ করছি। বাকি দায় বিক্রেতাদের।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, সরকারি সব হাসপাতালেই সব ধরণের স্যালাইন আছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেই প্রয়োজনীয় সব স্যালাইন হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে। ওষুধের দোকানদারেরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। স্যালাইন নিয়ে বাজারে যা চলছে তা আমরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। কৃত্রিম এই সংকট থাকবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, স্যালাইন সংকটের কারণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের সময় বিভিন্ন ফার্মেসিতে আমরা স্যালাইন পেয়েছি। বাজারে স্যালাইন আছে। আমরা গেলে তারা স্যালাইন আছে বলে জানায়। এতে করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আর কিছু করার থাকে না। তবে আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, সাধারণ ক্রেতারা গেলে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে না, আবার বাড়তি দাম দিলে স্যালাইন দিচ্ছে। বিষয়টি দুঃখজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page